Friday, 26 February 2010

দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়

দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়
নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায়?
এমমি দশাই তার কপালে লেখে।
কথার পাকে মানুষ মেরে
মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে,
গড় করি তার অনেক তফাৎ থেকে।

*বিখ্যাত ইংরাজি কবিতার অনুকরণে

বড়াই

গাছের গোড়ায় গর্ত করে ব্যাং বেঁধেছেন বাসা,
মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গান ধরেছেন খাসা।
রাজার হাতি হাওদা -পিঠে হেলে দুলে আস্লে
বাপরে ব'লে ব্যাং বাবাজি গর্তে ঢোকেন ত্রাসে!
রাজার হাতি মেজাজ ভারি হাজার রকম চাল ;
হঠাৎ রেগে মটাং করে ভাঙল গাছের ডাল।
গাছের মাথায় চড়াই পাখি অবাক হ'য়ে কয়্ল
বাসরে বাস! হাতির গায়ে এমন জোরও হয়!
মুখ বাড়িয়ে ব্যাং বলে, ভাই তাইত তোরে বলি্ল
"আমরা, অথর্াৎ চার-পেয়েরা, এমি্ন ভাবেই চলি"

Thursday, 25 February 2010

অতীতের ছবি-৬

অতীতের ছবি – পর্ব ৬

ধরি নব পথ নূতন ধারা
নবীন প্রেরণে আসিল যারা,
আজি তাঁহাদের চরণ ধরি
ভক্তিভরে সবে স্মরণ করি।
শাস্ত্রী শবনাথ সকল ফেলি
বিষয় বাসনা চরণে ঠেলি
বহু নির্যাতন বহিয়া শিরে,
অনুরাগে ভাসি নয়ন নীরে,
সর্বত্যাগী হয়ে ব্যাকুল প্রাণে
ছুটে আসে ওই কিসের টানে,
দেখ ওই চলে পাগলমত
ভক্তশ্রেষ্ট বীর বিনয়নত,
বিজয় গোঁসাই সরল প্রাণ-
হেরি আজি তাঁই প্রেম বয়ান।
সাধু রামতনু জ্ঞানে প্রবীণ,
শিশুর মতন চির নবীন।
শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন,
কর্মনিষ্ঠাময় সাধু জীবন ।
নগেন্দ্র নাথের যুকতি বানে
কূট তর্ক যত নিমেষে হানে ।
আনন্দমোহন মুরতি যার।
উমেশচন্দ্রের জীবণ মন ,
নীরব সাধনে সদা মগন।
দুর্গামোহনের জীবনগত
সমাজের সেবা দানের ব্রত।
দ্বারকানাথের স্মরন হয়
ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয় ।
পূর্ব বঙ্গে হোথা সাধক কত
নবধর্ম বানী প্রচারে কত।
সংসারে নিলিপ্ত ভাবুক প্রাণ
স্বার্থক প্রচারে কালীনারান
কত নাম কব কত যে জ্ঞানী
কত ভক্ত সাধু যোগী ও ধ্যানী;
কত মধুময় প্রেমিক মন
আড়ম্বহীন সেবকজন ;
আসিল হেথায় আকাশ ভরে
সবার যতনে সমাজ গড়ে।
এই যে মন্দির হেরিছ যার
ইটকাঠ ময় স্থুল আকার ;
ইহারি মাঝারে কত যেস্মৃতি,
কত আকিঞ্চন সমাজ প্রীতি,
ব্যাকুল ভাবনা দিবস রাত
বিনিদ্র সাধনে জীবন পাত ।
বহু কর্মময় এই সমাজ
সে সব কাহিনী না কব আজ,
আজিকে কেবল স্মরণে আনি
ব্রাহ্মসমাজের মহান বাণী ।
যে বাণী শুনুনু রাজার মুখে,
মহর্ষি যাহারে ধরিল বুকে,
কেশব যে বাণী প্রচার কারে-
স্মরি আজ তাহা ভকতি ভরে।
রক্তাক্ষরে লিখা যে বাণী রটে
এই সমাজের জীবনপটে-
“স্বাধীন মানবহৃদয়তলে
বিবেকের শিখা নিয়ত জ্বলে।
গুরুর আদেশ সাধুর বাণী
ইহার উপরে কারে না মানি?”
স্বাধীন মানে এই সমাজ
মুক্ত ধর্মলাভে ইহার কাজ।
হেথায় সকল বিরোধ গুচি
রবে নানা মত নানান্ রুচি
কাহারো রচিত বিধি বিধান
রুধিবে না হেথা কাহারো প্রাণ।
প্রতি জীবনের বিবেক ভাতি
সবার জীবনে জ্বলিবে বাতি।
নর নারী হেথা মিলিয়া সবে
সম অধিকারে আসন লাভে।
প্রেমেতে বিশাল জ্ঞানে গভীর
চরিত্রে সংযত করমে বীর ;
ঈশ্বরে ভক্তি মানবে প্রীতি,
হেথা মানুষের জীবন নীতি।
ফুরাল কি সব হেথায় আসি ?
আসিবে না প্রেম জড়তা নাশি?
জাগিবে না প্রাণ ব্যাকুল হয়ে,
নব নব বাণী জীবনে লয়ে ?
জ্বলিবে না নব সাধন শিখা ?
নব ইতিহাস হবে না লিখা ?
চিররুদ্ধ রবে পুজার দ্বার ?
আসিবে না নব পুজারী আর ?
কোথাও আশার আলো কি নাহি ?
শুধাই সবার বদন চাহি।

অতীতের ছবি-৫

অতীতের ছবি – পর্ব ৫

সমাজে সুদিন এল আবার,
ক্রমে প্রসারিল জীবন তার।
কেশব আপন প্রতিভা বলে
যতনে গঠিল যুবকদলে।
নগরে নগরে হল প্রচার-
“ধর্ম রাজ্যে নাহি জাতিবিচার;
নাহি ভেদ হেথা নারী ও নরে,
ভক্তি আছে যার সে যায় ত’রে।
জাতিবর্ণ- ভেদ কুরীতি যত
ভাঙি দাও চিরদিনের মত।
দেশ দেশান্তরে ধাঊক মন,
সর্বধর্মবাণী কর চয়ন;
ধর্মে ধর্মে নাহি বিরোধ রবে,
মহা সমম্বয় গঠিত হবে।”
পশিল সে বাণী দেশের প্রাণে,
মুগ্ধ নরনারী অবাক মানে ।
নগরে নগরে তুফান উঠে,
ঘরে ঘরে কত বাঁধন টুটে;
ব্রহ্ম নামে সবে ছুটিয়া চলে,
প্রাণ হতে প্রাণে আগুন জ্বলে।
আসিল গোঁসাই ব্যাকুল হয়ে
প্রেমে ভরপূর ভকতি লয়ে।
আসিল প্রতাপ স্বভাব ধীর,
গম্ভীর বচন জ্ঞানে গভীর।
স্বল্পভাষী সাধু অঘোরনাথ
যোগমগ্ন মন দিবসরাত।
গৌরগোবিন্দের সাধক প্রাণ
হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর অতুল জ্ঞান।
কান্তিচন্দ্র সদা সেবায় রত
সেবাধর্ম তাঁর জীবন-ব্রত।
ত্রৈলোক্যনাথের সরস গান
নব নব ভাবে মাতায় প্রাণ।
আরো কত সাধু ধরমমতি
বঙ্গচন্দ্র আদি প্রচার-ব্রতী
একসাথে মিলি প্রেমের ভরে
প্রেমপরিবার গঠন করে।
কাল কিবা খাবে কেহ না জানে,
আকুল উৎসাহ সবার প্রাণে ।
নূতন মন্দির নব সমাজ
নব ভাবে কত নূতন কাজ।
দিনে দিনে নব প্রেরণা পায়,
উৎসাহের স্রোত বাড়িয়া যায়।
সমাজ-চালনা বিধি-বিচার
কেশবের হাতে সকল ভার;
কেশবপ্রেরণা সবার মূলে
তাঁর নামে সবে আপনা ভুলে।
ধন্য ব্রহ্মানন্দ যাঁহার বাণী
শিরে ধরে লোকে প্রমাণ মানি।
যাঁহার সাধনা আজিও হেরি
রয়েছে সমাজ জীবন ঘেরি ;
যাঁহার মূরতি স্মরণ করি,
যাঁহার জীবন হৃদয়ে ধরি,
শত শত লোক প্রেরণা পায়-
আজি ভক্তিভরে প্রণমি তাঁয়।
আবার বহিল নূতন ধারা,
সমাজের প্রাণে বাজিল সাড়া;
ভাসি বহুজনে সে নব স্রোতে
বাহির হাইল নূতন পথে।
মিলি অনুরাগে যতন ভরে
এই “সাধারণ” সমাজ গড়ে।
ওদিকে কেশব নূতন বলে
বাঁধিল আবার আপন দলে।
নব ভাবে “নববিধান” গড়ি,
নূতন সংহিতা রচনা করি,
ভগ্নদেহ লয়ে অবশপ্রায়,
খাটিতে খাটিতে ত্যজিল কায়।

অতীতের ছবি-৪

অতীতের ছবি – পর্ব ৪

ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে
একা বসি তার রজনী কাটে।
অদূরে অন্তিম শয়নোপরি
দিদিমা তাহার আছেন পড়ি,
সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে
পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে,
তাহারি মাঝারে নদীর তীরে
হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে।
একাকী যুবক বসিয়া কুলে
সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে।
প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি
ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি,
তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব
বিলাস বাসনা অসার সব,
অজানা কি যেন সহসা স্মরি
পলকে পরান উঠিল ভরি।
আর কি সে মন বিরাম মানে?
গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে।
কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা
শুধায় সবারে না পায় দিশা।
-সহসা একদা তাহার ঘরে
ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ;
কি যেন বচন লিখিত তায়
অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়।
বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে
যুবা সে বাণীর মরম লভে-
“যাহা কিছু এই জগততলে
অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে
ব্রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-”
শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়।
শুনি মহাবাণী চমক লাগে,
আরো জানিব রে বাসনা জাগে
ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন
গভীর সাধনে হল মগন:
যত ডোবে আরো ডুবিতে চায়
ডুবি নব নব রতন পায়া।
হেনকালে হল অশনিপাত
যুবকের পিতা দ্বারকানাথ,
অতুল সম্পদ ধন বিভব
ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব
কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ
অকালে সহসা ত্যজিল দেহ।
আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে,
“যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে-
কর অস্বীকার ঋণের দায়
নহিলে তোমার সকলি যায়।”
নাহি টলে তায় যুবার মন,
পিতৃঋণ শোধ করিল পণ,
হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন
ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ।
উত্তমর্ণজনে অবাক মানি
কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী,
“বিষয় বিভব থাকুক তব,
মোরা তাহা হতে কিছু না লব।
সাধুতা তোমার তুলনাহীন;
সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।”
বরষের পর বরষ যায়,
যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়।
সংসারে বাসনা -বিগত মন,
ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন,
ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান ,
ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান;
বচনেতে যেন অমৃত ঝরে-
নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে।
ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে
দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে
ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়,
কত শত লোকে শুনিতে ধায়।
“ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে,
প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে।
হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে,
সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে।
জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে ,
যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে ।
জানিবার পথ নাহিক আর,
নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর ।
বহু তর্ক বহু বিচার বলে
বহু জপ তপ সাধন ফলে
বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে
নাহি পায় সেই বচনাতীতে।”
ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে ,
মহর্ষির বানী চেতনা আনে।
দলে দলে লোক সেথায় ছোটে
ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে।
মত্ত অনুরাগে কেশব ধায়,
প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়;
আকুল আগ্রহে পরান খুলি
ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি।
হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে
“ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে ।
লভি নব প্রানে সমাজ কায়
নব নব ভাবে বিকাশ পায় ;
ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন,
ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন
ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে
তাহে নিমগন পুলক ভরে ।

অতীতের ছবি-৩

অতীতের ছবি – পর্ব ৩

এখনও গভীর তমসা রাতি,
ভারত ভবনে নিভিছে বাতি -
মানুষ না দেখি ভারতভূমে,
সবাই মগন গভীর ঘুমে।
কত জাতি আজ হেলার ভরে
হেথায় আসিয়া বসতি করে।
ভারতের বুকে নিশান গাথি
বসেছে সবলে আসন পাতি।
নিজ ধনমান নিজ বিভব
বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব,
ভারতের মুখে না ফুটে বাণী,
মৌন রহে দেশ শরম মানি।
- হেনকালে শুন ভেদি আঁধার
সুগম্ভীর বানী উঠিল কার-
“ভাব সেই এক ভাবহ তারে,
জলে স্থলে শুন্যে হেরিছ যারে
নিয়ত যাহার স্বরূপ ধ্যানে
দিব্য জ্ঞান জাগে মানব প্রাণে।
ছাড় তুচ্ছ পূজা জড় সাধন,
মিথ্যা দেবসেবা ছাড়া এখন,
বেদান্তের বাণী স্মরণ কর,
ব্রহ্মজ্ঞান-শিখা হৃদয়ে ধর
সত্য মিথ্যা দেখে করি বিচার
খুলি দাও যত মনের দ্বার ।
মানুষের মত স্বাধীন প্রাণ
নির্ভয়ে তাকাও জগত পানে-
দিকে দিকে দেখ ঘুচিছে রাতি,
দিকে দিকে জাগে কত না জাতি;
দিকে দিকে লোক সাধনারত
জ্ঞানের ভান্ডার খুলেছে কত।
নাহি কি তোমার জ্ঞানের খনি ?
বেদান্ত রতন মুকুটমণি?
অসারে মজে কি ভুলেছ তুমি-
ধর্মে গরীয়ান ভারতভুমি?”
-শুনি মৃতদেশ পরান পায়,
বিস্ময়ে মানুষ ফিরিয়া চায়।
দেখে দিব্যরূপ পুরুষ বরে
কান্তি তেজোময় নয়ন হরে,
গবল শরীর সুঠাম অতি,
ললাট প্রসর, নয়নে জ্যোতি,
গম্ভীর স্বভাব,বচন ধীর,
সত্যের সংগ্রামে অজেয় বীর;
অতুল প্রখর প্রতিভা ধরে
নানা শাস্ত্র ভাষা বিচার করে।
রামমোহনের জীবন স্মরি,
কৃতজ্ঞতা ভরে প্রনাম করি।
দেশের দুর্গতি সকলখানে
হেরিয়া বাজিল রাজার প্রাণে ।
কত অসহায় অবোধ নারী
সতীত্বের নামে সকল ছাড়ি,
কেহ স্ব-ইচছায়, কেহবা ভয়ে,
শাসনে তাড়নে পিষিত হয়ে,
পতির চিতায় পুড়িয়া মরে-
শুনি কাদে প্রাণ তাদের তরে ।
নারীদুঃখ নাশ করিল পণ,
ঘুচিল নারীর সহমরণ ।
নিষ্কাম করম- যোগীর মত
দেশের কল্যাণ সাধনে রত,
নানা শাস্ত্রবাণী করে চয়ন,
দেশ দেশান্তের ঋষিবচন;
পশ্চিমের নব জ্ঞানের বাণী
দেশের সমুখে ধরিল আনি।
কিরূপেতে পুন এ ভারতভবে
ব্রহ্মজ্ঞান কথা প্রচার হবে ,
নিয়ত যতন তাহারি তরে,
কত শ্রম কত প্রয়াস করে ;
তর্ক আলোচনা কত বিচার
কত গ্রন্থ রচি’ করে প্রচার;
-ক্রমে বিনাশিতে জড় ধরম
‘ব্রহ্ম সমাজে’র হল জনম ।
শুনে দেশবাসি নুতন কথা,
মূরতিবিহীন পুজার প্রথা
উপাসনা -গৃহ দেখে নতুন-
যেথায় স্বদেশী বিদেশী জন
শুদ্র দ্বিজ আদি মিলিয়া সবে
নির্বিচারে সদা আসন লাভে।
মহাপুরুষের বিপুল শ্রমে
দেশে যুগান্তর আসিল ক্রমে।
স্বদেশের তার আকুল প্রাণ
প্রবাসেতে রাজা করে প্রয়ান;
সেথায় সুদুর বিলাতে হায়
অকালেতে রাজা ত্যজিল কায়।
অসমাপ্ত কাজ রহিল পড়ে,
ফিরে যায় লোকে নিরাশা ভরে;
একে একে সব যেতেছে চলে-
ভাসে রামচন্দ্র নয়নজলে।
রাজার জীবন নিয়ত স্মরি’
উপাসনা গৃহে রহে সে পড়ি,
নিয়ম ধরিয়া পূজার কালে
নিষ্ঠাভাবে সেথা প্রদীপ জ্বালে।
একা বসি ভাবে রাজার কাজ
এমন দুর্দিনে কে লবে আজ।

অতীতের ছবি-২

অতীতের ছবি – পর্ব ২

কালচক্রে হায় এমন দেশে
ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে।
দশদিকে হতে আঁধার আসি
ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি।
কোথা সে প্রাচীন জ্ঞানের জ্যোতি,
সত্য অন্বেষণে গভীর মতি ;
কোথা ব্রহ্মজ্ঞান সাধন ধন,
কোথা ঋষিগণ ধ্যানে মগন;
কোথা ব্রহ্মচারী তাপস যত,
কোথা সে ব্রাহ্মণ সাধনা রত?
একে একে সবে মিলাল কোথা,
আর নাহি শুনি প্রাচীন কথা।
মহামূল্য নিধি ঠেলিয়া পায়
হেলায় মানুষ হারাল তায়।
আপন স্বরূপ ভুলিয়া মন
ক্ষুদ্রের সাধনে হল মগন।
ক্ষুদ্র চিন্তা মাঝে নিয়ত মজি,
ক্ষুদ্র স্বার্থ-সুখ জীবনে ভাজি;
ক্ষুদ্র তৃপ্তি লয়ে মূঢ়ের মত
ক্ষুদ্রের সেবায় হইল রত।
রচি নব নব বিধি-বিধান
নিগড়ে বাঁধিল মানব প্রাণ;
সহস্র নিয়ম নিষেধ শত ;
তাহে বদ্ধ নর জড়ের মত ;
লিখি দাসখত ললাটে তার
রুদ্ধ করি দিল মনের দ্বার।
জ্বলন্ত যাঁহার প্রকাশ ভাবে-
হায়রে তাঁহারে ভুলিল সবে;
কল্পনার পিছে ধাইল মন,
কল্পিত দেবতা হল সৃজন,
কল্পিত রূপের মূরতি গড়ি,
মিথ্যা পূজাচার রচন করি,
ব্যাখ্যা করি তার মহিমা শত,
মিথ্যা শাস্ত্রবাণী রচিল কত।
তাহে তৃপ্ত হয়ে অবোধ নরে
রহে উদাসীন মোহের ভরে।
না জাগে জিজ্ঞাসা অলস মনে,
দেখিয়া না দেখে পরম ধনে।
ব্রাহ্মণেরে লোকে দেবতা মানি
নির্বিচারে শুনে তাহারি বাণী।
পিতৃপুরুষের প্রসাদ বরে
বসি উচ্চাসনে গরব ভরে
পূজা-উপচার নিয়ত লভি
ভুলিল ব্রাহ্মণ নিজ পদবী।
কিসে নিত্যকালে এ ভারতভাবে
আপন শাসন অঁটুট রবে-
এই চিন্তা সদা করি বিচার
হল স্বার্থপর হৃদয় তার।
ভেদবুদ্ধিময় মানব মন
নব নব ভেদ করে সৃজন।
জাতিরে ভাঙিয়া শতধা করে,
তাহার উপরে সমাজ গড়ে;
নানা বর্ণ নানা শ্রেণীবিচার ,
নানা কুটবিধি হল প্রচার।
ভেদ বুদ্ধি কত জীবন মাঝে
অশনে বসেন সকল কাজে,
ধর্ম অধিকারে বিচার ভেদ
মানুষে মানুষে করে প্রভেদ।
ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে,
জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে।
মিথ্যা অহংকারে মোহের বশে
জাতির একতা বাঁধন খসে:
হয়ে আত্মঘাতী ভারতভবে
আপন কল্যণ ভুলিল সবে।

অতীতের ছবি

অতীতের ছবি – পর্ব ১

ছিল এ ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন ;
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।
আকাশে তখন তারকা চলে,
নদী যায় ভেসে, সাগর টলে,
বাতাস ছুটিছে আপন কাজে,
পৃথিবী সাজিছে নানান সাজে ;
ফুলে ফলে ছয় ঋতুর খেলা,
কত রূপ কত রঙের মেলা;
মুখরিত বন পাখির গানে,
অটঁল পাহাড় মগন ধ্যানে;
নীলকাশে গন মেঘের ঘটাঁ,
তাহে ইন্দ্রধনু বিজলী ছঁটা,
তাহে বারিধারা পড়িছে ঝরি-
দেখিত মানুষ নয়ন ভরি।
কোথায় চলেছে কিসের টানে
কোথা হতে আসে, কেহ না জানে।
ভাবিত মানব দিবস-যামী,
ইহারি মাঝারে জাগিয়া আমি,
কিছু নাহি বুঝি কিছু নাহি জানি,
দেখি দেখি আর অবাক মানি।
কেন চলি ফিরি কিসের লাগি
কখন ঘুমাই কখন জাগি,
কত কান্না হাসি দুখে ও সুখে
ক্ষুধা তৃষ্ণা কত বাজিছে বুকে।
জন্ম লভি জীব জীবন ধরে,
কোথায় মিলায় মরণ পরে?
ভবিতে ভাবিতে আকুল প্রাণে
ডুবিত মানব গভীর ধ্যানে।
অকূল রহস্য তিমিরতলে,
জ্ঞানজ্যোতিময় প্রদীপ জ্বলে,
সমাহিত চিতে যতন করি
অচঞ্চল শিখা সে আলো ধরি
দিব্য জ্ঞানময় নয়ন লভি,
হেরিল নতুন জগত ছবি।
অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে
ভাসিয়া চলেছে অকুল পথে
প্রতি ধুলিকণা নিখিল টানে
এক হতে ধায় একেরি পানে,
চলেছে একেরি শাসন মানি,
লোকে লোকান্তরে একেরি বাণী
এক সে অমৃতে হয়েছে হারা
নিখিল জীবন-মরণ ধারা।
সে অমৃতজ্যোতি আকাশ ঘেরি,
অন্তরে বাহিরে অমৃত হেরি।
যাঁহা হতে জীব জনম লভে,
যাহা হতে ধরে জীবন সবে,
যাহার মাঝারে মরণ পরে
ফিরি পুন সবে প্রবেশ করে,
তাহার জানিবে যতন ধরি।
তিনি ব্রহ্ম তারে প্রনাম করি।
আনন্দেতে জীব জনম লভে
আনন্দে জীবিত রয়েছে সবে;
আনন্দে বিরাম লভিয়া প্রাণ
আনন্দের মাঝে করে প্রয়াণ।
শুন বিশ্বলোক শুনহ বাণী
অমৃতের পুত্র সকল প্রাণী,
দিব্যধামিবাসী শুনহ সবে-
জেনেছি তাহারে, যিনি এ ভবে
মহান পুরুষ নিখিল গতি,
তমসার পরে পরম জ্যোতি :
তেজোময় রূপে হেরিয়া তাঁরে
স্তব্ধ হয় মন, বচন হারে।
বামে ও দখিনে উপরে নীচে,
ভিতরে বাহিরে সমুখে পিছে,
কিবা জলেস্থলে আকাশ পরে
আধারে আলোকে চেতনে জড়ে:
আমার মাঝারে আমারে ঘেরি
এক ব্রহ্মময় প্রকাশ হেরি।
সে আলোকে চাহি আপন পানে
আপনারে মন স্বরূপ জানে।
আমি আমি করি দিবস- যামী,
না জানি কেমন কোথা সে আমি
অজর অমর অরূপ রূপ
নহি আমি এই জড়ের স্তুপ
দেহ নহে মোর চির-নিবাস
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।
বিশ্ব আত্মা মাঝে হয়ে মগন
আপন স্বরূপ হেরিলে মন
না থাকে সন্দেহ না থাকে ভয়
শোক তাপ মোহে নিমেষে লয়,
জীবনে মরণে না রহে ছেদ,
ইহা পরলোকে না রহে ভেদ।
ব্রহ্মানন্দময় পরম ধাম,
হেথা আসি সবে লভে বিরাম;
পরম সম্পদ পরম গতি,
লভ তাঁরে জীব যতনে অতি।

আবোল তাবোল

আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে খ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর।
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন্‌ সুদূর।
আয় খ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্‌ ধিন্‌,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজ্‌গুবি চাল্‌ বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে-
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।

বিচার

ইঁদুর দেখে মাম্‌‌দো কুকুর বল্‌‌লে তেড়ে হেঁকে-
"বল্‌‌ব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে ।
আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা,
আয় না খেলি দুইজনেতে মোকদ্দমা খেলা ।
তুই হবি চোর, তোর নামেতে করব নালিশ রুজু"-
"জজ্‌‌ কে হবে ?" বল্‌‌লে ইঁদুর, বিষম ভয়ে জুজু,
"কোথায় উকিল, প্যায়দা পুলিশ, বিচার কিসে হবে ?"
মাম্‌‌দো বলে, "তাও জানিস্‌‌নে ? শোন বলে দেই তবে ।
আমিই হব উকিল হাকিম, আমিই হব জুরি,
কান ধ'রে তোর বল্‌‌ব, "ব্যাটা, ফের করেছিস্‌‌ চুরি ?"
সটান দেব ফাঁসির হুকুম অম্‌‌নি একেবারে-
বুঝ্‌‌বি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে ।"

ও বাবা!

পড়তে বসে মুখের কাছে কাগজখানি থুয়ে
রমেশ ভায়া ঘুমোয় পড়ে আরাম ক'রে শুয়ে ।
শুনছ নাকি ঘডর ঘড়র নাক ডাকার ধূম ?
সখ যে বড় বেজায় দেখি- দিনের বেলায় ঘুম !

বাতাস পোরা এই যে থলি দেখ্‌‌ছ আমার হাতে,
দুড়ম করে পিট্‌‌লে পরে শব্দ হবে তাতে ।
রমেশ ভায়া আঁৎ‌কে উঠে পড়্‌‌বে কুপোকাৎ‌
লাগাও তবে- ধূমধারাক্কা ! ক্যাবাৎ‌ ! ক্যাবাৎ‌ !

ও বাবারে ! এ কেরে ভাই ! মারবে নাকি চাঁটি ?
আমি ভাবছি রমেশ বুঝি ! সব করেছে মাটি !
আবার দেখ চোখ পাকিয়ে আস্‌‌ছে আমায় তেড়ে-
আর কেন ভাই ? দৌড়ে পালাই, প্রাণের আশা ছেড়ে !

কত বড়

ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।

যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
"ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?"

'ভাল ছেলের' নালিশ

মাগো!
প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা
গুড় মাখিয়ে আরাম ক'রে বসে -
আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,
দুইখানা সেই আপনি খেল ক'ষে!
তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে
কিল মেরেছি 'হ্যাংলা ছেলে' বলে-
অম্‌‌নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে
গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!

মাগো!
এম্‌‌নিধারা শয়তানি তার, খেলতে গেলাম দুপুরে,
বল্‌ল, 'এখন খেলতে আমার মানা'-
ঘন্টাখানেক পরেই দেখি দিব্যি ছাতের উপরে
ওড়াচ্ছে তার সবুজ ঘুড়ি খানা।
তাইতে আমি দৌড়ে গিয়ে ঢিল মেরে আর খুঁচিয়ে
ঘুড়ির পেটে দিলাম করে ফুটো-
আবার দেখ বুক ফুলিয়ে সটান মাথা উঁচিয়ে
আনছে কিনে নতুন ঘুড়ি দুটো!

অন্ধ মেয়ে

গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা,
রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা!
সবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি
রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!

অন্ধ মেয়ে দেখ্‌‌ছে না তা - নাইবা যদি দেখে-
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!
শুন্‌‌ছে সে যে পাখির ডাকে হরষ কোলাকুলি
মিষ্ট ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!
দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,
তারও আধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।

হারিয়ে পাওয়া

ঠাকুরদাদার চশমা কোথা ?
ওরে গণ্‌শা, হাবুল, ভোঁতা,
দেখ্‌না হেথা, দেখ্‌না হোথা- খোঁজ না নিচে গিয়ে ।

কই কই কই? কোথায় গেল ?
টেবিল টানো, ডেস্কো ঠেল,
ঘরদোর সব উলটে ফেল- খোঁচাও লাঠি দিয়ে ।

খুঁজছে মিছে কুঁজোর পিছে,
জুতোর ফাঁকে, খাটের নিচে,
কেউ বা জোরে পর্দা খিঁচে- বিছনা দেখে ঝেড়ে-

লাফিয়ে ঘুরে হাঁফিয়ে ঘেমে
ক্লান্ত সবে পড়্‌ল থেমে,
ঠাকুরদাদা আপনি নেমে আসেন তেড়েমেড়ে ।

বলেন রেগে, "চশমাটা কি
ঠাং গজিয়ে ভাগ্‌ল নাকি ?
খোঁজার নামে কেবল ফাঁকি- দেখছি আমি এসে !"

যেমন বলা দারূণ রোষে,
কপাল থেকে অম্নি খ'সে
চশমা পড়ে তক্তপোশে- সবাই ওঠে হেসে !

আশ্চর্য !

নিরীহ কলম, নিরীহ কালি,
নিরীহ কাগজে লিখিল গালি-
"বাঁদর বেকুব আজব হাঁদা
বকাট্‌ ফাজিল অকাট্‌ গাধা ।"
আবার লিখিল কলম ধরি
বচন মিষ্টি, যতন করি-
"শান্ত মানিক শিষ্ট সাধু
বাছারে ধনরে, লক্ষ্মী যাদু ।"
মনের কথাটি ছিল যে মনে,
রটিয়া উঠিল খাতার কোণে,
আঁচড়ে আঁকিতে আখর ক'টি
কেহ খুশি কেহ উঠিল চটি !
রকম রকম কালির টানে
কারো হাসি কারো অশ্রু আনে,
মারে না, ধরে না, হাঁকে না বুলি
লোকে হাসে কাঁদে কি দেখি ভুলি ?
সাদায় কালো কি খেলা জানে ?
ভাবিয়া ভাবিয়া না পাই মানে ।

হরিষে বিষাদ

দেখছে খোকা পঞ্জিকাতে এই বছরে কখন কবে
ছুটির কত খবর লেখে, কিসের ছুটি ক'দিন হবে ।
ঈদ্‌ মহরম দোল্‌ দেওয়ালি বড়দিন আর বর্ষশেষে-
ভাবছে যত, ফুল্লমুখে ফুর্তিভরে ফেলছে হেসে ।
এমনকালে নীল আকাশে হঠাৎ-খ্যাপা মেঘের মত,
উথ্‌‌লে ছোটে কান্নাধারা ডুবিয়ে তাহার হর্ষ যত ।
"কি হল তোর ?" সবাই বলে, "কলমটা কি বিধল হাতে ?
জিবে কি তোর দাঁত বসালি ? কামড়াল কি ছারপোকাতে ?"
প্রশ্ন শুনে কান্না চড়ে অশ্রু ঝরে দ্বিগুণ বেগে,
পঞ্জিকাটি আছড়ে ফেলে বললে কেঁদে আগুন রেগে ;
"ঈদ্‌ পড়েছে জষ্ঠি মাসে গ্রীষ্মে যখন থাকেই ছুটি,
বর্ষাশেষ আর দোল্‌ ত দেখি রোব্‌বারেতেই পড়ল দুটি ।
দিনগুলোকে করলে মাটি মিথ্যে পাজি পঞ্জিকাতে-
মুখ ধোব না ভাত খাব না ঘুম যাব না আজকে রাতে ।"

অসম্ভব নয় !

এক যে ছিল সাহেব, তাহার
গুণের মধ্যে নাকের বাহার ।
তার যে গাধা বাহন, সেটা
যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা ।
ডাইনে বললে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দুবার থামে ।
চল্‌‌তে চল্‌‌তে থেকে থেকে
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে ।
ব্যাপার দেখে এম্নিতরো
সাহেব বললে, "সবুর করো-
মামদোবাজি আমার কাছে ?
এ রোগেরও ওষুধ আছে ।"
এই না ব'লে ভীষ্ণ ক্ষেপে
গাধার পিঠে বস্‌ল চেপে
মুলোর ঝুঁটি ঝুলিয়ে নাকে ।
আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে ?
মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে
দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে-
যতই চলে ধরব ব'লে
ততই মুলো এগিয়ে চলে !
খাবার লোভে উদাস প্রাণে
কেবল ছোটে মুলোর টানে-
ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে
ফেরেন গাধা নাকের চালে ।

পাকাপাকি

আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইঁট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে ।
রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে ।
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে ।
হাত পাকে লিখে লিখে চুল পাকে বয়সে,
জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে ।
লোকে বলে কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে ?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে !
কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টন্‌টন্‌-
কথা যার পাকা নয় কাজে তার ঠন্‌ঠন্‌ ।
রাঁধুনী বসিয়ে পাকে পাক দেয় হাঁড়িতে,
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে ।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে ।
দুহাতে পাকালে গোঁফ তবু নাহি পাকে সে ।।

দাঁড়ের কবিতা

চুপ কর, শোন্‌ শোন্‌, বেয়াকুল হোস্‌‌নে-
ঠেকে গেছি বাপ্‌‌রে কি ভয়ানক প্রশ্নে !
ভেবে ভেবে লিখে লিখে বসে বসে দাঁড়েতে
ঝিম্‌ঝিম্‌ টন্‌টন্‌ ব্যথা করে হাড়েতে ।
এক ছিল দাঁড়িমাঝি- দাড়ি তার মস্ত,
দাড়ি দিয়ে দাঁড়ি তার দাঁড়ে খালি ঘষ্‌ত ।
সেই দাঁড়ে একদিন দাঁড়কাক দাঁড়াল,
কাঁকড়ার দাঁড়া দিয়ে দাঁড়ি তারে তাড়াল ।
কাক বলে রেগেমেগে, "বাড়াবাড়ি ঐ ত !
না দাঁড়াই দাঁড়ে তবু দাঁড়কাক হই ত ?
ভারি তোর দাঁড়িগিরি, শোন্‌ বলি তবে রে-
দাঁড় বিনা তুই ব্যাটা দাঁড়ি হোস্‌ কবে রে ?
পাখা হলে পাখি হয় ব্যাকরণ বিশেষে-
কাঁকড়ার 'দাঁড়া' আছে, দাঁড়ি নয় কিসে সে ?
দ্বারে বসে দারোয়ান, তারে যদি 'দ্বারী' কয়,
দাঁড়ে-বসা যত পাখি সব তবে দাঁড়ি হয় !
দূর দূর ! ছাই দাঁড়ি ! দাড়ি নিয়ে পাড়ি দে !"
দাঁড়ি বলে, "ব্যাস্‌ ব্যাস্‌ ! ঐখেনে দাঁড়ি দে ।"

আবোল তাবোল

মেঘ মুলুকে ঝাপ্‌সা রাতে,
রামধনুকের আব্‌ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কণ্ঠ পুরে ।
হেথায় নিষেধ নাই রে দাদা,
নাই রে বাঁধন নাইরে বাধা ।
হেথায় রঙিন্‌ আকাশ তলে
স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে,
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে,
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ !
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক্‌
নাইবা বুঝুক বেবাক্‌ লোক ।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে ।
ছুট্‌লে কথা থামায় কে ?
আজকে ঠেকায় আমায় কে ?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ্‌ তব্‌লা বাজে-
রাম-খটাখট্‌ ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্‌
কথায় কাটে কথার প্যাঁচ্‌ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার ।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভূত !
হ্যাংলা হাতি চ্যাং-দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা ।
মক্ষি রাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষী আজ ।
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর ।

কাঁদুনে

ছিঁচ্‌কাঁদুনে মিচ্‌‌কে যারা শস্তা কেঁদে নাম কেনে,
ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যানঘ্যানে আর প্যানপ্যানে-
কুঁকিয়ে কাঁদে ক্ষিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধমকালে,
কিম্বা হঠাত্‍‌ লাগলে ব্যথা, কিম্বা ভয়ে চম্‌কালে ;
অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই,
মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই-
তারেই বলি মিথ্যে কাঁদন; আসল কান্না শুনবে কে?
অবাক্ হবে থম্‌কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে !
নন্দঘোষের পাশের বাড়ি বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার
কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার ।
কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে,
কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন-কাঁদুনে রাক্ষুসে !
নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা,
হঠাৎ‌ শুনি অর্থবিহীন আকাশ-ফাটন জোর গলা ।
হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান,
বাপ-মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান ।
বাস রে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই?
কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই !
ঝুমঝুমি দাও, পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার,
বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার ।
কান্নাভরে উল্‌টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে,
গিল্‌তে চাহে দালানবাড়ি হাঁ'খানি তার হাঁক্ দিয়ে,
ভূত-ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে-
কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ সাহেবের বাচ্চারে ।

হাত গণনা

ও পাড়ার নন্দ গোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো,
স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো।
ছিল না তার অসুখবিসুখ, ছিল যে সে মনের সুখে,
দেখা যেত সদাই তারে হুঁকোহাতে হাস্যমুখে।
হঠাত্‍‌ কি তার খেয়াল হল, চল্‌ল সে তার হাত দেখাতে-
ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্ কাঁপছে দাঁতে!
শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে,
মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে।
শুনে লোক দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই,
সবাই বলে, `কাঁদছ কেন? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?'
খুড়ো বলে, `বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা
আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা।
এতদিন যায় নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে-
হঠাত্‍‌ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে?
ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে-
ওরে তোদের নন্দখুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে।
কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা-'
এই ব'লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা।
দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো,
বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো।

ভুতুড়ে খেলা

পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছ্‌নাতে।
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত-পা নেড়ে উল্লাসে,
আহ্লাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে।
শুনতে পেলাম ভুতের মায়ের মুচকি হাসি কট্‌কটে-
দেখছে নেড়ে ঝুন্‌‌টি ধ'রে বাচ্চা কেমন চট্‌পটে।
উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে,
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে!
যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা,
আদর ক'রে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা।
বলছে আবার, ``আয় রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে,
দেখ না ফিরে প্যাখ্‌না ধরে হুতোম-হাসি মুখ করে!
ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁত্কা রে,
অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে!
ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্ঠি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান-ছেঁড়া জষ্ঠিমধুর মিষ্টি রে।
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছ্‌না হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার।
ওরে আমার গোবরাগণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্ রে,
ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে-''
এই না বলে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্ ক'রে,
কোথায়-বা কি, ভুতের ফাঁকি- মিলিয়ে গেল চট্ ক'রে!

ভয় পেয়ো না

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না---
সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না---
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?
এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্‌কা এমন মারলে তোমার লাগবে না।
অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে---
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

আহ্লাদী

হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী,
তিনজনেতে জট্‌লা ক'রে ফোক্‌লা হাসির পাল্লা দি ।
হাসতে হাসতে আসছে দাদা, হাসছি আমি, হাসছে ভাই,
হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই ।
ভাবছি মনে, হাসছি কেন ? থাকব হাসি ত্যাগ ক'রে,
ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেল্‌ছি হাসি ফ্যাক্‌ ক'রে ।
পাচ্ছে হাসি চাপতে গিয়ে, পাচ্ছে হাসি চোখ বুজে,
পাচ্ছে হাসি চিম্‌টি কেটে নাকের ভিতর নোখ্‌ গুঁজে ।
হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড়
নৌকা ফানুস পিঁপড়ে মানুষ রেলের গাড়ী তেলের ভাঁড় ।
পড়তে গিয়ে ফেলছি হেসে 'ক খ গ' আর শ্লেট দেখে-
উঠ্‌ছে হাসি ভস্‌ভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে ।

নারদ! নারদ!

"হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল সাদাকে বলেছিলি লাল ?
(আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে নাক ডেকেছিস বিশ্রী সুরে ?
(আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো শুন্‌‌ছি নাকি বেজায় হুলো ?
(আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি কেউ নাকি রাখেনা দাড়ি ?
ক্যান্‌ রে ব্যাটা ইসটুপিড ? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্‌ !"
"চোপরাও তুম্‌ স্পিকটি নট্‌ মারব রেগে পটাপট্‌-
ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার করবি রোখ,
কিম্বা যদি অমনি ক'রে মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস্‌ জোরে-
আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস আমি স্যান্ডো করি ?"
"ফের লাফাচ্ছিস্‌ ! অলরাইট্‌ কামেন্‌ ফাইট্‌ ! কামেন্‌ ফাইট্‌ !"
"ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি !
আজকে যদি থাকত মামা পিটিয়ে তোমায় কর্‌ত ধামা ।"
"আরে ! আরে ! মারবি নাকি ? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি !"
"হাঁহাঁহাঁহাঁ ! রাগ করো না, করতে চাও কি তাই বল না !"
"হাঁ হাঁ তাতো সত্যি বটেই আমি তো আর চটিনি মোটেই !
মিথ্যে কেন লড়তে যাবি ? ভেরি-ভেরি সরি, মশলা খাবি ?"
"শেকহ্যান্ড' আর 'দাদা' বল সব শোধ বোধ ঘরে চল ।"
"ডোন্ট পরোয়া অল্‌ রাইট্‌ হাউ ডুয়ুডু গুড্‌ নাইট্‌ ।"

ফস্‌‌কে গেল

দেখ্‌ বাবাজি দেখ্‌‌বি নাকি দেখ্‌‌রে খেলা দেখ্‌ চালাকি,
ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড়্‌ পড়্‌ পড়্‌ পড়্‌‌বি পাখি- ধপ্‌ !

লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক ক'রে যাই তীর ধনুকে,
ছাড়্‌ব সটান উর্ধ্বমুখে হুশ্‌ ক'রে তোর লাগবে বুকে- খপ্‌ !

গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়্‌ গুড়িয়ে হামা খাপ্‌ পেতেছেন গোষ্ঠো মামা
এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা এইবার বাণ চিড়িয়া নামা- চট্‌ !

এই যা ! গেল ফস্কে ফেঁসে- হেঁই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে ?
ঘ্যাঁচ্‌ ক'রে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্‌ল কি বাণ ছট্‌‌কে এসে- ফট্‌ ?

গল্প বলা

"এক যে রাজা"- "থাম না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা ।"
"তার যে মাতুল"- "মাতুল কি সে ?
সবাই জানে সে তার পিসে ।"
"তার ছিল এক ছাগল ছানা"-
"ছাগলের কি গজায় ডানা ?"
"একদিন তার ছাতের 'পরে"-
"ছাত কোথায় হে টিনের ঘরে ?"
"বাগানের এক উড়ে মালী"-
"মালি নয় ত ? মেহের আলি-"
"মনের সাধে গাইছে বেহাগ"-
"বেহাগ তো নয় বসন্ত রাগ ।"
"থোও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি"-
"আচ্ছা বল চুপ্‌ করেছি ।"
"এমন সময় বিছনা ছেড়ে
হঠাৎ মামা আস্‌ল তেড়ে,
ধরল সে তার ঝুঁটির গোড়া-"
"কোথায় ঝুঁটি ? টাক যে ভরা ।"
"হোক না টেকো, তোর তাতে কি ?
লক্ষীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি ।
ধরব ঠেসে টুঁটির 'পরে,
পিট্‌ব তোমার মুণ্ডু ধরে-
কথার উপর কেবল কথা,
এখন বাপু পালাও কোথা ?"

ডানপিটে

বাপ্‌রে কি ডানপিটে ছেলে !-
কোন্‌ দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে ।
একটা সে ভূত সেজে আঠা মেখে মুখে,
ঠাঁই ঠাঁই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে ।
অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে,
খাট থেকে রাগ ক'রে দুম্‌দাম্‌ পড়ে !

বাপ্‌রে কি ডানপিটে ছেলে !-
শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে !
একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘষে,
এক মনে মোমবাতি দেশলাই চোষে !
আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে,
কপ্‌ কপ্‌ মাছি ধ'রে মুখে দেয় তুলে !

বাপ্‌রে কি ডানপিটে ছেলে !-
খুন হত টম চাচা ওই রুটি খেলে !
সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে,
রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস ফোঁস ফোলে !
নেড়াচুল খাড়া হয়ে রাঙা হয় রাগে,
বাপ্‌ বাপ্‌ ব'লে চাচা লাফ দিয়ে ভাগে ।

দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম

ছুট্‌‌ছে মোটর ঘটর ঘটর ছুট্‌‌ছে গাড়ী জুড়ি ;
ছুট্‌‌ছে লোকে নানান্‌ ঝোঁকে করছে হুড়োহুড়ি ;
ছুট্‌‌ছে কত ক্ষ্যাপার মত পড়্‌‌ছে কত চাপা-
সাহেব মেম থম্‌‌কে থেমে বল্‌‌ছে 'মামা ! পাপা !'
-আমরা তবু তবলা ঠুকে গাচ্ছি কেমন তেড়ে,
"দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম ! দেড়ে দেড়ে দেড়ে !"
বর্ষাকালের বৃষ্টিবাদল রাস্তা জুড়ে কাদা,
ঠাণ্ডা রাতে সর্দিবাতে মরবি কেন দাদা ?
হোক্‌ না সকাল হোক্‌ না বিকেল হোক্‌ না দুপুর বেলা,
থাক্‌ না তোমার আফিস যাওয়া থাক্‌ না কাজের ঠেলা-
এই দেখ না চাঁদনি রাতের গান এনেছি কেড়ে,
"দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম ! দেড়ে দেড়ে দেড়ে !"
মুখ্যু যারা হচ্ছে সারা পড়্‌ছে ব'সে একা,
কেউ বা দেখ কাঁচুর মাচুর কেউ বা ভ্যাবাচ্যাকা ;
কেউ বা ভেবে হদ্দ হল, মুখটি যেন কালি ;
কেউ বা ব'সে বোকার মত মুণ্ডু নাড়ে খালি ।
তার চেয়ে ভাই, ভাবনা ভুলে গাও না গলা ছেড়ে,
"দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম ! দেড়ে দেড়ে দেড়ে !"
বেজার হয়ে যে যার মত করছ সময় নষ্ট-
হাঁট্‌ছ কত খাট্‌ছ কত পাচ্ছ কত কষ্ট !
আসল কথা বুঝছ না যে, করছ না যে চিন্তা,
শুনছ না যে গানের মাঝে তব্‌লা বাজে ধিন্‌তা ?
"পাল্লা ধ'রে গায়ের জোরে গিট্‌কিরি দাও ঝেড়ে,
"দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম ! দেড়ে দেড়ে দেড়ে !"

কাতুকুতু বুড়ো

আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেওনা খবরদার !
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেওনা তার বাড়ি-
কাতুকুতুর কুল্‌‌পি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি ।
কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌ সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক'রে ভাই গল্প শোনায় প'ড়ে ।
বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো, না জানি কোন্‌ দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি ।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা, না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে ।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে ।
কেবল বলে, "হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি-
বেচ্ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি ।
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ-বেরঙের আল্‌পনা সব আঁকা ।
অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ ক'রে মিহি,
ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীহি ।"
এই না বলে কুটুৎ ক'রে চিমটি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে ।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি ।

বিজ্ঞান শিক্ষা

আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি 'ফুটোস্কোপ' দিয়ে
দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে ।
কোন্‌ দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন্‌ দিকে থেকে যায় চাপা ;
কতখানি ভস্‌ ভস্‌ ঘিলু, কতখানি ঠক্‌ ঠকে কাঁপা ।
মন তোর কোন্‌ দেশে থাকে , কেন তুই ভুলে যাস্‌ কথা-
আয় দেখি কোন্‌ ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তর কোথা ।
টোল-খাওয়া ছাতাপড়া মাথা, ফাটামত মনে হয় যেন,
আয় দেখি বিশ্লেষ ক'রে- চোপ্‌ রও ভয় পাস্‌ কেন ?
কাৎ হ'য়ে কান ধ'রে দাঁড়া, জিভ্‌খানা উল্‌‌টিয়ে দেখা,
ভালো ক'রে বুঝে শুনে দেখি- বিজ্ঞানে যে রকম লেখা ।
মুণ্ডুতে 'ম্যাগনেট্‌' ফেলে, বাঁশ দিয়ে 'রিফ্লেক্‌ট্‌'
ইঁট দিয়ে 'ভেলসিটি' ক'ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে ।

ট্যাঁশ গরু

ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে ;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে ।
চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত,
ফিট্‌ফাট্‌ কালোচুলে টেরিখানা চোস্ত ।
তিন-বাঁকা শিং তার, ল্যাজখানি প্যাঁচান-
একটুকু ছোও যদি, বাপ্‌রে কি চ্যাঁচান !
লট্‌খটে হাড়গোড় খট্‌খট্‌ ন'ড়ে যায়,
ধম্‌কালে ল্যাগ্‌ব্যাগ্‌ চমকিয়ে প'ড়ে যায় ।
বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার,
চেহারার কি বাহার- ঐ দেখ ছবি তার ।
ট্যাঁশ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্‌ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে ;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায় ।
খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি
খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি ;
রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়সে
সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে ।
আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্‌খক্‌,
সারা গায়ে ঘিন্‌ ঘিন্‌, ঠ্যাং কাঁপে ঠক্‌ঠক্‌ ।
একদিন খেয়েছিল ন্যাক্‌ড়ার ফালি সে-
তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে ।
কারো যদি শখ্‌ থাকে ট্যাঁশ গরু কিন্‌তে,
সস্তায় দিতে পারি, দেখ ভেবে চিন্তে ।

গন্ধ বিচার

সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘণ্টা,
ছট্‌ফটিয়ে উঠ্‌ল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা ।
বল্‌‌লে রাজা, "মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ ?"
মন্ত্রী বলে, "এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ !"
রাজা বলে, "মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি, "
বদ্যি বলে, "আমার নাকে বেজায় হল সর্দি ।"
রাজা হাঁকেন, "বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র ।"
পাত্র বলে, "নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে ?"
রাজা বলেন, "কোটাল তবে এগিয়ে এস, শুঁকবে ।"
কোটাল কহে, "পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুণ্ডু আমার এক্কেবারে ভরপুর ।"
রাজা বলেন, "আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,"
ভীম বলে, "আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্‌ ঝিম্‌ ।
রাত্রে আমার বোখার হল, বল্‌ছি হুজুর ঠিক বাৎ"-
ব'লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত । রাজার শালা চন্দ্রকেতু তারেই ধ'রে শেষটা
বল্‌ল রাজা, "তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা ।"
চন্দ্র বলেন, "মারতে চাও ত ডাকাও না হয় জল্লাদ,
গন্ধ শুঁকে মর‌‌তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ ?"
ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্‌‌লে মনে, "ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-"
সাহস ক'রে বল্‌‌লে বুড়ো, "মিথ্যে সবাই বক্‌‌ছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্‌‌শিস ।"
রাজা বলেন, "হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,"
তাই না শুনে উৎসাহেতে উঠ্‌ল বুড়ো মদ্দ ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুঁক্‌ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্‌‌লে লোকে বিষ্ময়ে বাক্‌ বন্ধ ।
রাজ্যে হল জয় জয়কার বাজ্‌ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্‌‌রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা !

হুলোর গান

বিদ্‌ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্‌ঘুটে ফাঁকা,
গাছপালা মিশ্‌মিশে মখ্‌মলে ঢাকা ।
জট্‌বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে,
ধক্‌ধক্‌ জোনাকির চক্‌মকি জ্বলে,
চুপ্‌চাপ্‌ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো-
আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো ।

গীত গাই কানে কানে চীৎকার ক'রে,
কোন্‌ গানে মন ভাঙে শোন্‌ বলি তোরে-
পূবদিকে মাঝ রাতে ছোপ্‌ দিয়ে রাঙা
রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা ।
চট্‌ ক'রে মনে পড়ে মট্‌কার কাছে
মালপোয়া আধাখানা কাল থেকে আছে ।

দুড়্‌ দুড়্‌ ছুটে যাই দূর থেকে দেখি
প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী ।
গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা
ধুক ক'রে নিভে গেল বুকভরা আশা ;
মন বলে আর কেন সংসারে থাকি
বিল্‌কুল্‌ সব দেখি ভেল্‌কির ফাঁকি ।

সব যেন বিচ্ছিরি সব যেন খালি,
গিন্নীর মুখ যেন চিম্‌নির কালি ।
মন ভাঙা দুখ্‌ মোর কণ্ঠেতে পুরে
গান গাই আয় ভাই প্রাণফাটা সুরে ।

বুঝিয়ে বলা

ও শ্যামাদাস ! আয় ত দেখি ব'স তো দেখি এখেনে,
সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখে নে ।
জ্বর হয়েছে ? মিথ্যে কথা ! ওসব তোদের চালাকি-
এই যে বাবা চেঁচাচ্ছিলে, শুনতে পাইনি ? কালা কি?
মামার ব্যামো ? বদ্যি ডাকবি ? ডাকিস নাহয় বিকেলে ;
না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে ।
আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব-
না বুঝ্‌‌বি ত মগজে তোর গজাল দিয়ে গোঁজাব ।
কোন্‌ কথাটা ? তাও ভুলেছিস ? ছেড়ে দিছিস্‌ হাওয়াতে ?
কি বলছিলেম পরশু রাতে বিষ্টুবোসের দাওয়াতে ?
ভুলিস্‌‌নি ত বেশ করেছিস্‌, আবার শুনলে ক্ষেতি কি ?
বড় যে তুই পালিয়ে বেড়াস্‌, মাড়াস্‌‌নে যে এদিক্‌ই !
বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন ? বইগুলো আন্‌ নামিয়ে-
তুই থাকতে মুটের বোঝা বইতে যাব আমি এ ?
সাবধানেতে আন্‌, ধরছি দাঁড়া- সেই আমাকেই ঘামালি-
এই খেয়েছে ! কোন্‌ আক্কেলে শব্দকোষটা নামালি ?
ঢের হয়েছে ! আয় দেখি তুই বোস্‌ ত দেখি এদিকে-
ওরে গোপাল, গোটাকয়েক পান দিতে বল্‌ খেঁদিকে ।
বলছিলেম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ণ হতে স্থূলেতে,
অর্থাৎ কিনা লাগ্‌ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে-
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক'রে,
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে ।
অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর রোদ পড়েছে ঘাসেতে,
এই মনে কর চাঁদের আলো পড়ল তারই পাশেতে-
আবার দেখ ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি ?
আকাশপানে তাকাস্‌ খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি ?
কি বল্লি তুই ? এ সব শুধু আবোল তাবোল বকুনি ?
বুঝতে হলে মগজ লাগে, ব'লেছিলেম তখুনি ।
মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে,
যায় কি দেওয়া কোন কথা তার ভিতরে ঢুকিয়ে ?-
ও শ্যামাদাস ! উঠলি কেন ? কেবল যে চাস পালাতে !
না শুনবি ত মিথ্যে সবাই আসিস কেন জ্বালাতে ?
তত্ত্বকথা যায় না কানে যত মরি চেঁচিয়ে-
ইচ্ছে করে ডান্‌‌পিটেদের কান ম'লে দি পেঁচিয়ে ।

নোট বই

এই দেখ পেন্সিল, নোটবুক এ হাতে,
এই দেখ ভরা সব কিল্‌বিল লেখাতে ।
ভালো কথা শুনি যেই চট্‌ পট্‌ লিখি তায়-
ফড়িঙের ক'টা ঠ্যাং, আরশুলা কি কি খায় ।
আঙুলেতে আঠা দিলে লাগে কেন চট্‌চট্‌,
কাতুকুতু দিলে কেন গরু করে ছট্‌ফট্‌ ।
দেখে শিখে প'ড়ে শুনে ব'সে মাথা ঘামিয়ে
নিজে নিজে আগাগোড়া লিখে গেছি আমি এ ।
কান করে কট্‌ কট্‌, ফোড়া করে টন্‌ টন্‌-
ওরে রামা ছুটে আয়, নিয়ে আয় লণ্ঠন ।
কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খট্‌কা
ঝোলাগুড় কিসে দেয়, সাবান না পট্‌কা ?
এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে
জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে ।
পেট কেন কাম্‌ড়ায়, বল দেখি পার কে ?
বল দেখি ঝাঁজ কেন জোয়ানের আরকে ?
তেজপাতে তেজ কেন ? ঝাল কেন লঙ্কায় ?
নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায় ?
কার নাম দুন্দুভি ? কাকে বলে অরণি ?
বল্‌বে কি ? তোমরা ও নোট্‌বই পড় নি ।

বোম্বাগড়ের রাজা

কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা-
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা ?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা ?
পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা ?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে ?
জোছ্‌না রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে ?
ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে ?
টাকের 'পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে ।
রাত্রে কেন ট্যাঁক্‌ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে ?
কেন রাজার বিছ্‌না পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে ?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা "হুক্কা হুয়া" ব'লে ?
মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় ব'সে রাজার কোলে ?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি ?
কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী ?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা প'রে ?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে ?

একুশে আইন

শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে !
কেউ যদি পা পিছলে প'ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার-
একুশ টাকা দণ্ড তার ।।

সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচ্‌‌তে হ'লে টিকিট লাগে
হাঁচ্‌‌লে পরে বিন্‌ টিকিটে
দম্‌দমাদম্‌ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে-
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে ।।

কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,
চারটি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাকসো চায়-
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠেকায় একুশ বার।।

চল্‌‌তে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্‌ ওদিক্‌ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
একুশ হাতা জল গেলায়।।

যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধ'রে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্‌ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদির খাতা-
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।

হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে
একশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।।

সাবধান

আরে আরে, ওকি কর প্যালারাম বিশ্বাস ?
ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ অত জোরে ফেলোনাকো নিঃশ্বাস ।
জানোনা কি সে বছর ওপাড়ার ভূতোনাথ,
নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে হয়েছিল কুপোকাৎ ?
হাঁপ ছাড় হ্যাস্‌ফ্যাঁস্‌ ও রকম হাঁ ক'রে-
মুখে যদি ঢুকে বসে পোকা মাছি মাকড়ে ?
বিপিনের খুড়ো হয় বুড়ো সেই হল' রায়,
মাছি খেয়ে পাঁচ মাস ভুগেছিল কলেরায় ।
তাই বলি- সাবধান ! ক'রোনাকো ধুপ্‌ধাপ্‌,
টিপি টিপি পায় পায় চলে যাও চুপ্‌ চাপ্‌ ।
চেয়োনাকো আগে পিছে, যেয়োনাকো ডাইনে
সাবধানে বাঁচে লোকে,- এই লেখা আইনে ।
পড়েছ ত কথামালা ? কে যেন সে কি ক'রে
পথে যেতে পড়ে গেল পাতকো'র ভিতরে ।
ভালো কথা- আর যেন সকালে কি দুপুরে,
নেয়োনাকো কোনো দিন ঘোষেদের পুকুরে ।
এরকম মোটা দেহে কি যে হবে কোন্‌ দিন,
কথাটাকে ভেবে দেখ কি রকম সঙ্গিন !
চটো কেন ? হয় নয় কেবা জানে পষ্ট,
যদি কিছু হ'য়ে পড়ে পাবে শেষে কষ্ট ।
মিছিমিছি ঘ্যান্‌ঘ্যান্‌ কেন কর তক্ক ?
শিখেছ জ্যাঠামো খালি, ইঁচড়েতে পক্ক ।
মানবে না কোন কথা চলা ফেরা আহারে,
একদিন টের পাবে ঠেলা কয় কাহারে ।
রমেশের মেঝ মামা সেও ছিল সেয়না,
যত বলি ভালো কথা কানে কিছু নেয় না
শেষকালে একদিন চান্নির বাজারে
প'ড়ে গেল গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে !

পালোয়ান

খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতী লোফেন যখন তখন,
দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন ।
একদিন এক গুণ্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মার্‌ল বেগে-
ভাঙল সে বাঁশ শোলার মত মট্‌ করে তার কনুই লেগে ।
এইত সেদিন রাস্তা দিয়ে চল্‌তে গিয়ে দৈব বশে,
উপর থেকে প্রকাণ্ড ইট পড়্‌ল তাহার মাথায় খ'সে ।
মুণ্ডুতে তার যেম্‌নি ঠেকা অম্‌নি সে ইঁট এক নিমেষে
গুঁড়িয়ে হ'ল ধুলোর মত, ষষ্ঠি চলেন মুচকি হেসে ।
ষষ্ঠি যখন ধ্মক হাঁকে কাঁপতে থাকে দালান বাড়ী,
ফুঁয়ের জোরে পথের মোড়ে উল্টে পড়ে গরুর গাড়ী ।
ধুম্‌সো কাঠের তক্তা ছেঁড়ে মোচড় মেরে মুহূর্তেকে,
একশ জালা জল ঢালে রোজ স্নানের সময় পুকুর থেকে ।
সকাল বেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া,
সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া ।
দুপুর হ'লে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্‌চি ভ'রে,
বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে ।
বিকাল বেলা খায়না কিছু গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া,
সন্ধা হ'লে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া ।
রাত্রে সে তার হাত পা টেপায় দশটি চেলা মজুত থাকে,
দুম্‌দুমাদুম্‌ সবাই মিলে মুগুর দিয়ে পেটায় তাকে ।
বল্‌লে বেশি ভাব্‌বে শেষে এসব কথা ফেনিয়ে বলা-
দেখবে যদি আপন চোখে যাওনা কেন বেনিয়াটোলা ।

লড়াই-ক্ষ্যাপা

ওই আমাদের পাগলা জগাই, নিত্যি হেথায় আসে ;
আপন মনে গুন্‌ গুনিয়ে মুচকি হাসি হাসে ।
চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধ্মক লেগে থামে,
তড়াক্‌ করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে ।
ভীষণ রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোঁচা ;
"এইয়ো" বলে ক্ষ্যাপার মতো শূন্যে মারে খোঁচা ।
চেঁচিয়ে বলে, "ফাঁদ পেতেছ ? জগাই কি তায় পড়ে ?
সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে ।"
উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িংবিড়িং নাচে,
কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে ।
এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস্‌ধাপুস্‌ কত !
চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মত ।
লাফের চোটে হাঁফিয়ে ওঠে গায়েতে ঘাম ঝরে,
দুড়ুম ক'রে মাটির পরে লম্বা হয়ে পড়ে ।
হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখটি ক'রে ঘোলা,
"জগাই মলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা" !
এই না বলে মিনিট খানেক ছট্‌ফটিয়ে খুব,
মড়ার মত শক্ত হয়ে এক্কেবারে চুপ ।
তার পরেতে সটান্‌ ব'সে চুলকে খানিক মাথা,
পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা ।
লিখলে তাতে, "শোন্‌‌রে জগাই, ভীষণ লড়াই হলো
পাঁচ ব্যাটাকে খতম ক'রে জগাই দাদা মলো ।"

ন্যাড়া বেল তলা যায় ক'বার

রোদে রাঙা ইটের পাঁজা তার উপরে বস্‌ল রাজা-
ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিল্‌ছে না ।
গায়ে আটা গরম জামা পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা ;
রাজা বলে "বৃষ্টি নামা- নইলে কিচ্ছু মিলছে না ।"
থাকে সারা দুপুর ধ'রে ব'সে ব'সে চুপটি ক'রে,
হাঁড়িপানা মুখটি ক'রে আঁক্‌ড়ে ধ'রে শ্লেটটুকু ;
ঘেমে ঘেমে উঠছে ভিজে ভ্যাবাচ্যাকা একলা নিজে
হিজিবিজি লিখছে কি যে বুঝ্‌ছে না কেউ একটুকু ।
ঝাঁঝাঁ রোদ আকাশ জুড়ে, মাথাটার ঝাঁঝরা ফুঁড়ে,
মগজেতে নাচ্‌ছে ঘুরে রক্তগুলো ঝনর্‌ ঝন্‌ ;
ঠাঠা-পড়া দুপুর দিনে, রাজা বলে, "আর বাচিনে,
ছুটে আন বরফ কিনে- করছে কেমন গা ছন্‌ছন্‌ ।"
সবে বলে, "হায় কি হ্ল ! রাজা বুঝি ভেবেই মোলো !
ওগো রাজা মুখটি খোলো- কওনা ইহার কারণ কি ?
রাঙামুখ পান্‌সে যেন তেলে ভাজা আম্‌সি হেন,
রাজা এত ঘামসে কেন- শুনতে মোদের বারণ কি ?"
রাজা বলে , "কেই বা শোনে যে কথাটি ঘুরছে মনে,
মগজের নানান কোণে- আনছি টেনে বাইরে তায়,
সে কথাটি বলছি শোন, যতই ভাব যতই গোন,
নাহি তার জবাব কোন কুলকিনারা নাই রে হায় ।
লেখা আছে পুঁথির পাতে, "ন্যাড়া যায় বেলতলাতে,"
নাহি কোনো সন্ধ তাতে- কিন্তু প্রশ্ন 'ক'বার যায় ?'
এ কথাটা এদ্দিনেও পারে নিকো বুঝতে কেও,
লিখে নিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায় ।
লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে ?
ভেবে তাই পাইনে দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার ?"
একথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিও'লা
ঢিপ্‌ ক'রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম কর্‌ল দুপায় তাঁর ।
হেসে বলে, "আজ্ঞে সে কি ? এতে আর গোল হবে কি?
নেড়াকে তো নিত্য দেখি আপন চোখে পরিষ্কার-
আমাদেরি বেলতলা যে নেড়া সেথা খেলতে আসে
হরে দরে হয় ত মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশবার ।"

রামগরুড়ের ছানা

রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
"হাস্‌ব না-না না-না" ।
সদাই মরে ত্রাসে- ঐ বুঝি কেউ হাসে !
এক চোখে তাই মিট্‌মিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে ।
ঘুম নাহি তার চোখে আপনি ব'কে ব'কে
আপনারে কয়, "হাসিস্‌ যদি
মারব কিন্তু তোকে !"
যায় না বনের কাছে, কিম্বা গাছে গাছে,
দখিন হাওয়ার সুড়্‌সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে !
সোয়াস্তি নেই মনে- মেঘের কোণে কোণে
হাসির বাস্প উঠছে ফেঁপে
কান পেতে তাই শোনে ।
ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে
জোনাক্‌ জ্বলে আলোর তালে
হাসির ঠারে ঠারে ।
হাসতে হাসতে যারা হচ্ছে কেবল সারা
রামগরুড়ের লাগ্‌ছে ব্যথা
বুঝছে না কি তারা ?
রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা,
হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়
নিষেধ সেথায় হাসা ।

কিম্ভুত

বিদ্‌ঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভুত,
সারাদিন ধ'রে তার শুনি শুধু খুঁৎ খুঁৎ ।
মাঠপারে ঘাটপারে কেঁদে মরে খালি সে,
ঘ্যান ঘ্যান আবদারে ঘন ঘন নালিশে ।
এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না-
কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায় না ।
কোকিলের মত তার কণ্ঠেতে সুর চাই,
গলা শুনে আপনার বলে, "উঁহু, দূর ছাই !"
আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই-
তাই দেখে মরে কেঁদে- তার কেন ডানা নেই ।
হাতিটার কী বাহার দাঁতে আর শুণ্ডে-
ও রকম জুড়ে তার দিতে হবে মুণ্ডে ।
ক্যাঙ্গারুর লাফ দেখে ভারি তার হিংসে-
ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢ্যাঙে চিম্‌সে !
সিংহের কেশরের মত তার তেজ কৈ ?
পিছে খাসা গোসাপের খাঁজকাটা লেজ কৈ ?
একলা সে সব হ'লে মেটে তার প্যাখ্‌না ;
যারে পায় তারে বলে, "মোর দশা দেখ্‌ না !"

কেঁদে কেঁদে শেষটায়- আষাঢ়ের বাইশে
হ'ল বিনা চেষ্টায় চেয়েছে যা তাই সে ।
ভুলে গিয়ে কাঁদাকাটি আহ্লাদে আবেশে
চুপি চুপি একলাটি ব'সে ব'সে ভাবে সে-
লাফ দিয়ে হুঁশ করে হাতি কভু নাচে কি ?
কলাগাছ খেলে পরে ক্যাঙারুটা বাঁচে কি ?
ভোঁতামুখ কুহুডাক শুনে লোকে কবে কি ?
এই দেহে শুঁড়ো নাক খাপছাড়া হবে কি ?
"বুড়ো হাতি উড়ে" ব'লে কেউ যদি গালি দেয় ?
কান টেনে ল্যাজ ম'লে "দুয়ো" ব'লে তালি দেয় ?
কেউ যদি তেড়েমেড়ে বলে তার সামনেই-
"কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই ?"
জবাব কি দেবে ছাই, আছে কিছু বলবার ?
কাঁচুমাচু ব'সে তাই, মনে শুধু তোল্‌পাড়-
"নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু
মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু ।
মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই,
নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই !"

হাতুড়ে

একবার দেখে যাও ডাক্তারি কেরামৎ-
কাটা ছেঁড়া ভাঙা চোরা চট্‌পট মেরামৎ ।
কয়েছেন গুরু মোর, "শোন শোন বৎস,
কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্‌স" ।
উৎসাহে কি না হয় ? কি না হয় চেষ্টায় ?
অভ্যাসে চটপট্‌ হাত পাকে শেষটায় ।
খেটে খুটে জল হ'ল শরীরের রক্ত-
শিখে দেখি বিদ্যেটা নয় কিছু শক্ত ।
কাটা ছেঁড়া ঠুক্‌ ঠাক্‌, কত দেখ যন্ত্র,
ভেঙে চুরে জুড়ে দেই তারও জানি মন্ত্র ।
চোখ বুজে চট্‌পট বড় বড় মুর্তি,
যত কাটি ঘ্যাস্‌ ঘ্যাস্‌ তত বাড়ে ফুর্তি ।
ঠাং-কাটা গলাকাটা কত কাটা হস্ত,
শিরিষের আঠা দিয়ে জুড়ে দেয় চোস্ত ।
এইবারে বলি তাই, রোগী চাই জ্যান্ত-
ওরে ভোলা, গোটাছয় রোগী ধরে আন্‌ত !

গেঁটেবাতে ভুগে মরে ও পাড়ার নন্দী,
কিছুতেই সারাবেনা এই তার ফন্দি-
এক দিন এনে তারে এইখানে ভুলিয়ে,
গেঁটেবাত ঘেঁটে-ঘুঁটে সব দেব ঘুলিয়ে ।
কার কানে কট্‌মট্‌ কার নাকে সর্দি,
এস, এস, ভয় কিসে ? আমি আছি বদ্যি ।
শুয়ে কে রে ? ঠাং-ভাঙা ? ধরে আন্‌ এখেনে-
স্ক্রুপ দিয়ে এঁটে দিব কি রকম দেখেনে ।
গাল ফোলা কাঁদ কেন ? দাঁতে বুঝি বেদনা ?
এস এস ঠুকে দেই- আর মিছে কেঁদ না,
এই পাশে গোটা দুই, ওই পাশে তিনটে-
দাঁতগুলো টেনে দেখি- কোথা গেল চিম্‌‌টে ?
ছেলে হও, বুড়ো হও, অন্ধ কি পঙ্গু,
মোর কাছে ভেদ নাই, কলেরা কি ডেঙ্গু-
কালাজ্বর, পালাজ্বর, পুরানো কি টাট্‌কা,
হাতুড়ির এক ঘায়ে একেবারে আট্‌কা !

হুঁকোমুখো হ্যাংলা

হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ী তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই, দেখেছ ?
নাই তার মানে ক ? কেউ তাহা জানে কি ?
কেউ কভু তার কাছে থেকেছ ?

শ্যামাদাস মামা তার আপিঙের থানাদার,
আর তার কেউ নাই এছাড়া-
তাই বুঝি একা সে মুখখানা ফ্যাকাশে,
ব'সে আছে কাঁদ-কাঁদ বেচারা ?

থপ্‌ থপ্‌ পায়ে সে নাচ্‌ত যে আয়েসে,
গাল ভরা ছিল তার ফুর্তি,
গাইত সে সারাদিন 'সারে গামা টিম্‌টিম্‌',
আহ্লাদে গদ-গদ মূর্তি !

এইত সে দুপ'রে ব'সে ওই উপরে,
খাচ্ছিল কাঁচকলা চট্‌‌কে-
ওর মাঝে হল কি ? মামা তার মোলো কি ?
অথবা কি ঠ্যাং গেল মট্‌‌কে ?

হুঁকোমুখো হেঁকে কয়, আরে দূর, তা তো নয়,
দেখ্‌ছ না কি রকম চিন্তা ?
মাছি মারা ফন্দি এ যত ভাবি মন দিয়ে-
ভেবে ভেবে কেটে যায় দিনটা ।

বসে যদি ডাইনে, লেখে মোর আইনে-
এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত ;
বামে যদি বসে তাও, নহি আমি পিছপাও,
এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র !

যদি দেখি কোন পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি,
কি যে করি ভেবে নাহি পাইরে-
ভেবে দেখ একি দায়, কোন্‌ ল্যাজে মারি তায়
দুটি বই ল্যাজ মোর নাইরে !"

কি মুস্কিল

সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত,
সরকারী সব আফিসখানার কোন্‌ সাহেবের কদর কত ।
কেমন ক'রে চাট্‌‌নি বানায়, কেমন করে পোলাও করে,
হরেক্‌ রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখ্‌‌ছে ফলাও ক'রে ।
সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দাকেতা,
পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখ্‌‌ছে হেথা ।
সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়-
পাগ্‌লা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন ক'রে ঠেকাব তায় !

ঠিকানা

আরে আরে জগমোহন- এস, এস, এস-
বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেসো ?
আদ্যানাথের নাম শোননি ? খগেনকে তো চেনো ?
শ্যাম বাগ্‌চি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো ।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়ীওলা-
(কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা ;
তারই পিশের খুড়তুতো ভাই আদ্যানাথের মেশো-
লক্ষ্মী দাদা, ঠিকানা তার একটু জেনে এসো ।

ঠিকানা চাও ? বলছি শোন ; আমড়াতলার মোড়ে
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ'রে,
চলবে সিধে নাকবরাবর ডানদিকে চোখ রেখে ;
চল্‌‌তে চল্‌‌তে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে ।
দেখ্‌‌বে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত ,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মত ।
তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে ।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে-
তারপরে যাও ঝেথায় খুশী- জ্বালিও নাকো মোরে ।

ছায়াবাজি

আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা-
ছায়ার সাথে কুস্তি ক'রে গাত্র হ'ল ব্যথা !
ছায়া ধরার ব্যাবসা করি তাও জানোনা বুঝি,
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি !
শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা !
গ্রীষ্মকালে শুক্‌‌নো ছায়া ভীষন রোদে ভাজা,
চিলগুলো যায় দুপুর বেলায় আকাশ পথে ঘুরে
ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে ।
কাগের ছায়া বগের ছায়া দেখ্‌‌ছি কত ঘেঁটে-
হাল্কা মেঘের পান্‌‌সে ছায়া তাও দেখেছি চেটে ।
কেউ জানেনা এসব কথা কেউ বোঝে না কিছু,
কেউ ঘোরে না আমার মত ছায়ার পিছুপিছু ।
তোমরা ভাব গাছের ছায়া অম্‌‌নি লুটায় ভূঁয়ে,
অম্‌‌নি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্তা মতন শুয়ে ;
আসল ব্যাপার জান্‌‌বে যদি আমার কথা শোনো,
বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো ।
কেউ যবে তার রয় না কাছে, দেখতে নাহি পায়
গাছের ছায়া ফুটফুটিয়ে এদিক ওদিক চায় ।
সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হ'তে এসে
ধামায় চেপে ধপাস্‌ করে ধরবে তারে ঠেসে ।
পাৎলা ছায়া, ফোক্‌লা ছায়া, ছায়া গভীর কালো-
গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভালো ।
গাছ গাছালি শেকড় বাকল মিথ্যে সবাই গেলে,
বাপ্‌রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে ।
নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক,
যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক্‌ ।
চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পার,
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো ।
আম্‌ড়া গাছের নোংরা ছায়া কাম্‌‌ড়ে যদি খায়
ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নাই তায় ।
আষাঢ় মাসের বাদ্‌লা দিনে বাঁচতে যদি চাও ,
তেঁতুল তলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও ।
মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া 'ব্লটিং' দিয়ে শুষে
ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখ্‌‌ছি ঘরে পুষে !
পাক্কা নতুন টাট্‌কা ওষুধ এক্কেবারে দিশি-
দাম রেখেছি সস্তা বড়, চোদ্দ আনা শিশি ।

গানের গুঁতো

গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা-
আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা !
গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ,
ছুট্‌‌ছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্‌ ভন্‌ ।

মরছে কত জখম হয়ে কর্‌ছে কত ছট্‌ফট্‌-
বলছে হেঁকে, "প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্‌ পট্‌ ।"
বাঁধন-ছেড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিৎপাত ;
ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্‌পাত ।

চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়্‌‌ছে বেগে মুর্ছায়,
লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বল্‌‌ছে বেগে, "দূর ছাই" ।
জলের প্রানী অবাক মানি গভীর জলে চুপ চাপ,
গাছের বংশ হ'চ্ছে ধ্বংস পড়্‌ছে দেদার ঝুপ্ ঝাপ্‌ ।

শুন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী,
সবাই হাঁকে, 'আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী ।"
গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্‌কুল্‌
ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশ্‌‌মেজাজে দিল্‌ খুল্‌ ।

এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এম্‌‌নি সেটা ওস্তাদ,
গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাৎ ।
আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা
'বাপরে' ব'লে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা ।

খুড়োর কল

কল করেছেন আজব রকম চণ্ডীদাসের খুড়ো-
সবাই শুনে সাবাস্‌ বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো ।
খুড়োর যখন অল্প বয়স- বছর খানেক হবে-
উঠ্‌ল কেঁদে 'গুংগা' বলে ভীষণ অট্টরবে ।
আর সবাই 'মামা' 'গাগা' আবোল তাবোল বকে,
খুড়োর মুখে 'গুংগা' শুনে চম্‌‌কে গেল লোকে ।
বল্‌‌লে সবাই, "এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে,
বুদ্ধি জোরে এ সংসারেতে একটা কিছু হবে ।"
সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে,
পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে তিন ঘণ্টায় চলে ।
দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা,
ঘণ্টা পাঁচেক ঘাটলে পরে আপনি যাবে বোঝা ।
বল্‌ব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা,
ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা ।

সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যে রকম রুচি-
মণ্ডা মিঠাই চপ্‌ কাট্‌‌লেট্‌‌ খাজা কিংবা লুচি ।
মন বলে তায় 'খাব খাব', মুখ চলে তায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে ।
এমনি ক'রে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
উৎসাহেতে হুঁস্‌ রবে না চল্‌‌বে কেবল ধেয়ে ।
হেসে খেলে দু'দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,
খাবার গন্ধে পাগল হ'য়ে জিভের জলে ভেসে।
সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো,
অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো ।

চোর ধরা

আরে ছি ছি ! রাম রাম ! ব'লো না হে ব'লো না-
চল্‌‌ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা ।
যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে,
ভয়ানক ক'মে যায় খাবারের ভাগেতে ।
রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানিনেকো কারা সে-
কালকে যা হয়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে !
পাঁচখানা কাট্‌‌লেট্‌‌ লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্‌‌নি-
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতখানা শুন্যি !
তাই আজ ক্ষেপে গেছি- আর কত পারব ?
এতদিন স'য়ে স'য়ে এইবারে মারব ।
খাড়া আছি সারাদিন হুঁসিয়ার পাহারা,
দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা ।
রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস-
যেই হও এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ ।
খাট্‌বে না জারিজুরি আঁটবে না মারর্‌প্যাঁচ,
যারে পাব ঘাড়ে ধ'রে কেটে দেব ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ।
এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে,
এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে ।
রোজ বলি "সাবধান!" কানে তবু যায় না ?
ঠেলাখানা বুঝ্‌‌বি ত এইবারে আয় না !

গোঁফচুরি

হেড আফিসের বড় বাবু লোকটি বড়ই শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনও জান্‌ত ?
দিব্যি ছিলেন খোস্‌‌মেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা ব'সে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে !
আঁৎকে উঠে হাত পা ছুঁড়ে চোখটি ক'রে গোল
হঠাৎ বলেন, "গেলুম গেলুম, আমায় ধ'রে তোল" ।
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ বা হাঁকে পুলিশ,
কেউবা বলে, "কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস্‌।"
ব্যস্ত সবাই এদিক ওদিক কর্‌ছে ঘোরাঘুরি-
বাবু হাঁকেন, "ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি" !
গোঁফ হারান ! আজব কথা ! তাও কি হয় সত্যি ?
গোঁফ জোড়া ত তেমনি আছে, কমেনি এক রত্তি ।
সবাই তারে বুঝিয়ে বলে, সাম্‌‌নে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না ।
রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
"কারো কথার ধার ধারিনে, সব ব্যাটাকেই চিনি ।
"নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়না,
এমন গোফ ত রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
"এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই"-
এই না ব'লে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায় ।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়-
"কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায় ।
"আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
"গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর ।
"ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধ'রে খুব নাচি,
"মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধ'রে কোদাল দিয়ে চাঁচি ।
"গোঁফকে বলে তোমার আমার- গোঁফ কি কারও কেনা ?
"গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা ।"

প্যাঁচা আর প্যাঁচানি

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি,
খাসা তোর চ্যাঁচানি !
শুনে শুনে আন্‌মন
নাচে মোর প্রাণমন !
মাজা-গলা চাঁচা সুর
আহ্লাদে ভরপুর !
গলা চেরা গমকে
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিট্‌কিরি ক্যাঁচ্‌ ক্যাঁচ্‌ !
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক্‌ ধুক্‌,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে-
চাঁদ মুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু'নয়ান ।

শব্দ কল্প দ্রুম্‌

ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম্‌ দ্রাম্‌, শুনে লাগে খট্‌কা-
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা !
শাই শাই পন্‌পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ-
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ ?
হুড়মুড় ধুপ্‌ধাপ্‌- ওকি শুনি ভাই রে?
দেখ্‌ছ না হিম পড়ে- যেওনাকো বাইরে ।
চুপ্‌ চুপ্‌ ঐ শোন্‌ ! ঝুপ্‌ঝাপ্‌ ঝ-পাস্‌ !
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল ?- গব্‌ গব্‌ গবা-স্‌ !
খ্যাশ্‌ খ্যাশ্‌ ঘ্যাচ্‌ ঘ্যাচ্‌, রাত কাটে ঐরে !
দুড়্‌ দুড়্‌ চুরমার- ঘুম ভাঙে কই রে !
ঘর্ঘর ভন্‌ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা !
কত মন নাচে শোন্‌ - ধেই ধেই ধিন্‌তা !
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজে রে-
ফট্‌ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে !
হৈ হৈ মার মার , "বাপ্‌ বাপ্‌" চিৎকার-
মালকোঁচা মারে বুঝি? সরে পড়্‌ এইবার ।

বাবুরাম সাপুড়ে

বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস্‌ বাপুরে ?
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা !
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই নোখ্‌ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস ফাঁস,
মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ,
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধ ভাত-
সেই সাপ জ্যান্ত
গোটা দুই আনত ?
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক'রে দেই ঠাণ্ডা।

কুমড়ো পটাশ

যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ নাচে-
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে ;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে ;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমুলার গাছে !

(যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ কাঁদে-
খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে ;
উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে ;
বেহাগ সুরে গাইবে খালি 'রাধে কৃষ্ণ রাধে' !

(যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ হাসে-
থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে ;
ঝাপ্‌সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্‌ফাসে ;
তিনটি বেলা উপোস করে থাকবে শুয়ে ঘাসে !

(যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ ছোটে-
সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে ;
হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে ;
ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় নাকো মোটে !

(যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ ডাকে-
সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে ;
ছেঁচকি শাকের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মাখে ;
শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে !

তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা,
কুম্‌‌ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা ।
দেখবে তখন কোন্‌ কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিওনা, আগেই রাখি বলে ।

ভালরে ভাল

দাদা গো ! দেখ্‌‌ছি ভেবে অনেক দূর-
এই দুনিয়ার সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
সস্তা ভাল দামীও ভাল,
তুমিও ভাল আমিও ভাল,
হেথায় গানের ছন্দ ভাল,
হেথায় ফুলের গন্ধ ভাল,
মেঘ-মাখানো আকাশ ভাল,
ঢেউ-জাগানো বাতাস ভাল,
গ্রীষ্ম ভাল বর্ষা ভাল,
ময়লা ভাল ফরসা ভাল,
পোলাও ভাল কোর্মা ভাল,
মাছপটোলের দোলমা ভাল,
কাঁচাও ভাল পাকাও ভাল,
সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল,
কাঁসিও ভাল ঢাক্‌ও ভাল,
টিকিও ভাল টাকও ভাল,
ঠেলার গাড়ী ঠেল্‌‌তে ভাল,
খাস্তা লুচি বেলতে ভাল,
গিট্‌‌কিরি গান শুনতে ভাল,
শিমুল তুলো ধুন্‌‌তে ভাল,
ঠাণ্ডা জলে নাইতে ভাল,
কিন্তু সবার চাইতে ভাল-
-পাউরুটি আর ঝোলা গুড় ।

সৎপাত্র

শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে-
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?
জান্‌‌তে চাও সে কেমন ছেলে ?
মন্দ নয় সে পাত্র ভাল-
রঙ যদিও বেজায় কালো ;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন ।
বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই-
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !
উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থাম্‌ল শেষে ।
বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়-
কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যায় ।
মানুষ ত নয় ভাই গুলো তার-
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরি ছেলে,
জাল ক'রে নোট্‌ গেছেন জেলে ।
কনিষ্ঠটি তব্‌লা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।
গঙ্গারাম ত কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।
কিন্তু তারা উচচ ঘর
কংসরাজের বংশধর !
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের ।-
যাহোক্‌, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে ?

কাঠবুড়ো

হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে যেন কে বৃদ্ধ,
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ ।
মাথা নেড়ে গান করে গুন্‌ গুন্‌ সংগীত-
ভাব দেখে মনে হয় না জানি কি পণ্ডিত!

বিড়্‌ বিড়্‌ কি যে বকে নাহি তার অর্থ-
"আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত ।"
টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম,
রেগে বলে, "কেবা বোঝে এ সবের মর্ম?"

আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ,
বোঝেনাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব ।
কোন্‌ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব-
একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত?"

আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক-
ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য ;
কোন্‌ ফুটো খেতে ভাল, কোন্‌টা বা মন্দ,
কোন্‌ কোন্‌ ফাটলের কি রকম গন্ধ ।

কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক্‌ শব্দ,
বলে, "জানি কোন্‌ কাঠ কিসে হয় জব্দ ।
কাঠকুটো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট,
এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট ।

কোন্‌ কাঠ পোষ মানে, কোন্‌ কাঠ শান্ত,
কোন্‌ কাঠ টিম্‌টিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত ।
কোন্‌ কাঠে জ্ঞান নাই মিথ্যা কি সত্য,
আমি জানি কোন্‌ কাঠে কেন থাকে গর্ত ।"

খিচুড়ি

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল "হাঁসজারু" কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে - "বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।"
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা-
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি' সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে "আমারেও ধরিল কি ও রোগে?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?"
হাতিমির দশা দেখ, - তিমি ভাবে জলে যাই,
হাতি বলে, "এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।"
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট-
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।

আবোল তাবোল

আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে খ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর।
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন্‌ সুদূর।
আয় খ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্‌ ধিন্‌,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজ্‌গুবি চাল্‌ বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে-
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।

Friday, 19 February 2010

সুকুমার রায়

Sukumar Ray (Bangla:সুকুমার রায়) (1887-1923) was a Bengali humorous poet, story writer and playwright. As perhaps the most famous Indian practitioner of literary nonsense, he is often compared to Lewis Carroll. His works such as the collection of poems "Aboltabol" (Bangla: "আবোলতাবোল")("Gibberish"), novella "HaJaBaRaLa" (Bangla:হযবরল), short story collection "Pagla Dashu" (Bangla:"পাগলা দাশু") ("Crazy Dashu") and play "Chalachittachanchari" (Bangla: "চলচিত্তচঞ্চরী") are considered nonsense masterpieces equal in stature to Alice in Wonderland, and are regarded as some of the greatest treasures of Bangla literature. More than 80 years after his death, Ray remains one of the most popular of children's writers in both West Bengal and Bangladesh.

Sukumar Ray was the son of famous children's story writer Upendrakishore Ray (Ray Chowdhury) and the father of legendary Indian filmmaker Satyajit Ray. Sukumar Ray was also known as the convenor of "Monday Club", a weekly gathering of likeminded people at the Ray residence, where the members were free to express their irreverent opinions about the world at large. A number of delightful poems were penned by Sukumar Ray in relation to the matters concerning Monday Club, primarily soliciting attendance, announcing important meetings etc.

সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩) (ইংরেজি ভাষা: Sukumar Roy) একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে ননসেন্স্ এর প্রবর্তক। তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, লেখক, ছড়াকার, নাট্যকার। । তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তাঁর পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (Alice in Wonderland) ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর আশি বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।


জীবন
সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। সুকুমার ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। ১৮৮৭ সালে সুকুমার রায়ের জন্ম। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন।

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙ্গালী নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।

কলকাতার প্রেসিডেনসি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এসসি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংলান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি একটি ছোটদের মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনকে সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাড়ান।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কালাজ্বরে (লেইশ্মানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময় এই রোগের কোনো চিকিত্সা ছিলনা। তাঁর মৃত্যু হয় একমাত্র পুত্র সত্যজিত এবং স্ত্রীকে রেখে। সত্যজিত রায় ভবিষ্যতে একজন ভারতের অন্যতম চিত্রপরিচালক রূপে খ্যাতি অর্জন করেন, ও নিজের মৃত্যুর ৫ বছর আগে ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন।

কর্ম জীবন

সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলিতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল-তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।

প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তাঁর আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব নামে একই ধরণের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মানডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষনা ইত্যাদি।

ইংলান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা ও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পী রূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রজুক্তিবিদ দিকের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ড এর কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলি থেকে।

সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস কে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে - ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তাঁর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন।

গ্রন্থাবলী
আবোল তাবোল
পাগলা দাশু
হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি
খাই-খাই
অবাক জলপান
লক্ষণের শক্তিশেল
ঝালাপালা ও অনান্য নাটক
হ য ব র ল
শব্দ কল্প দ্রুম
চলচ্চিত্তচঞ্চরী
বহুরুপী
Link: http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC