Wednesday, 19 May 2010

মন্ডা ক্লাবের কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র



সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি তো যায় যায়।

তাই বলি সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।

রকমারি পুঁথি কত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে

করযোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।



কেউ বলেছে খাবো খাবো,
কেউ বলেছে খাই
সবাই মিলে গোল তুলেছে-
আমি তো আর নাই।

ছোটকু বলে, রইনু চুপে
ক'মাস ধরে কাহিল রূপে!
জংলি বলে "রামছাগলের
মাংস খেতে চাই।"

যতই বলি "সবুর কর" -
কেউ শোনে না কালা,
জীবন বলে কোমর বেধে,
কোথায় লুচির থালা?

খোদন বলে রেগেমেগে
ভীষণ রোষে বিষম লেগে-
বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে
হাজির যেন পাই।


শনিবার ১৭ ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতী মেলা।

অতএব ঘড়ি ধরে
সাবকাশ হয়ে
আসিবেন দয়া করে
হাসিমুখে লয়ে।

সরবৎ সদালাপ
সঙ্গীত - ভীতি
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ-ইতি।


আমি,অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাসতিনেক কল‌কেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।

বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া!
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়
আমার প্রাণে এসব কি সয়?

এখন থেকে সম্‌‌ঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,
আমি আবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।

শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার বিবেকানন্দ,
মঙ্গলবার আমার বাসায়।
(আর থেক না ভোজের আশায়)

সাহস

পুলিশ দেখে ডরাইনে আর, পালাইনে আর ভয়ে,
আরশুলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে।
আধাঁর ঘরে ঢুকতে পারি এই সাহসের গুণে,
আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে।
রাত্তিরেতে একলা শুয়ে তাও ত থাকি কত,
মেঘ ডাকলে চেঁচাইনেকো আহাম্মুকের মত।
মামার বাড়ির কুকুর দুটোর বাঘের মত চোখ,
তাদের আমি খাবার খাওয়াই এমনি আমার রোখ্!
এম্‌‌নি আরো নানান দিকে সাহস আমার খেলে
সবাই বলে "খুব বাহাদুর" কিংবা "সাবাস ছেলে"।
কিন্তু তবু শীতকালেতে সকালবেলায় হেন
ঠান্ডা জলে নাইতে হ'লে কান্না আসে কেন?
সাহস টাহস সব যে তখন কোনখানে যায় উড়ে-
ষাড়ের মতন কন্ঠ ছেড়ে চেঁচাই বিকট সুরে!

কানা-খোঁড়া সংবাদ

পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,
নাম ধাম নাহি জানা,
একজন তার খোড়া অতিশয়,
অপর ভূপতি কানা।
মন ছিল খোলা, অতি আলো ভোলা
ধরমেতে ছিল মতি,
পর ধনে সদা ছিল দোঁহাকার
বিরাগ বিকট অতি।
প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি
মেজাজ রাজারি মত,
শুনেছি কেবল, বুদ্ধিটা নাকি
নাহি ছিল সরু তত,
ভাই ভাই মত ছিল দুই রাজা,
না ছিল ঝগড়াঝাঁটি,
হেনকালে আসি তিন হাত জমি
সকল করিল মাটি।
তিন হাত জমি হেন ছিল, তাহা
কেহ নাহি জানে কার,
কহে খোঁড়া রায় "এক চক্ষু যার
এ জমি হইবে তার"।'
শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়
"আরে অভাগার পুত্র,
এ জমি তোমারি- দেখ না এখনি
খুলিয়া কাগজ পত্র"।
নক্সা রেখেছে এক বছর
বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি,
কীট কুটমতি কাটিয়া কাটিয়া
করিয়াছে তারে মাটি ;
কাজেই তর্ক না মিটিল হায়
বিরোধ বাধিল ভারি,
হইল য্দ্দু হদ্দ মতন
চৌদ্দ বছর ধরি।
মরিল সৈন্য, ভাঙিল অস্ত্র,
রক্ত চলিল বহি,
তিন হাত জমি তেমনি রহিল,
কারও হার জিত নাহি
তবে খোঁড়া রাজা কহে, হায় হায়,
তর্ক নাহিক মিটে,
ঘোরতর রণে অতি অকারণে
মরণ সবার ঘটে"
বলিতে বলিতে চঁটাৎ করিয়া
হঠাৎ মাথায় তার
অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল
অতীব চমৎকার।
কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,
শুন মোর কানা ভাই,
তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া
কখনও সুযশ নাই।
তার চেয়ে জমি দান করে ফেল
আপদ শান্তি হবে।"
কানা রাজা কহে, খাসা কথা ভাই,
কারে দিই কহ তবে।"
কহেন খঞ্জ, " আমার রাজ্যে
আছে তিন মহাবীর-
একটি পেটুক, অপর অলস,
তৃতীয় কুস্তিগীর।
তোমার মুলুক কে আছে এমন
এদের হারাতে পারে?-
সবার সমুখে তিন হাত জমি
বকশিস দিব তারে।
কানা রাজা কহে ভীমের দোসর
আছে ত মল্ল মম,
ফালাহারে পটু, পঁচাশি পেটুক
অলস কুমড়া সম।
দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি
আসুক তোমার লোক;
যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি-
খোড়া বলে, তাই হোক।
পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে
আলিশান সভা হবে,
তামাসা দেখিতে চারিদিক হতে
ছুটিয়া আসিল সবে।
ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথঘাট,
লোকে হল লোকাকার,
মহা কোলাহল দাড়াবার ঠাই
কোনোখানে নাহি আর।
তারপর ক্রমে রাজার হুকুমে
গোলমাল গেল থেমে,

দুইদিক হতে দুই পালোয়ান
আসরে আসিল নেমে।
লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল
গজ-কচ্ছপ হেন,
রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোহায়-
বজ্র পড়িল যেন!
গুঁতাইল কত ভোঁতাইল নাসা
উপাড়িল গোফ দাড়ি,
যতেক দন্ত করিল অন্ত
ভীষণ চাপটি মারি
তারপরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া
ছুঁড়িল এমনি জোরে,
গোলার মতন গেল গো উড়িয়া
দুই বীর বেগভরে।
কিহল তাদের কেহ নাহি জানে
নানা কথা কয় লোকে,
আজও কেহ তার পায়নি খবর,
কেহই দেখেনি চোখে।
যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে
এল পেটুকের পালা,
যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,
অথবা ঢাকাই জালা।
ওজনেতে তারা কেহ নহে কম,
ভোজনেতে ততোধিক,
বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষন-
ভারি সাতমন ঠিক।
অবাক দেখিছে সভার সকলে
আজব কান্ড ভারি-
ধামা ধামা লুচি নিমেষে ফুরায়
দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি!
দাড়ি পাল্লায় মাপিয়া সকলে
দেখে আহারের পরে ,
দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে
সাড়ে তিন মন করে।
কানা রাজা বলে একি হল জ্বালা,
আক্কেল নাই কারো ,
কেহ কি বোঝেনা সোজা কথা এই,
হয় জেতো নয় হারো।"
তার পর এল কুঁড়ে দুই জন
ঝাকার উপর চড়ে,
সভামাঝে দোহে শুয়ে চিৎপাত
চুপ চাপ রহে পড়ে।
হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,
কথা নাই কারো মুখে,
দিন দুই তিন রহিল পড়িয়া,
নাসা গীত গাহি সুখে।
জঠরে যখন জ্বলিল আগুন,
পরান কণ্ঠাগত,
তখন কেবল মেলিয়া আনন
থাকিল মড়ার মত।
দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ
নিকটে আসিয়া ছুটি
মুখের নিকটে ধরিল তাদের
চাটিম কদলি দুটি।
খঞ্জের লোকে কহিল কষ্টে,
"ছাড়িয়া দে নারে ভাই"
কানার ভৃত্য রহিল হা করে
মুখে তার কথা নাই ।
তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া
তায় কেরোসিন ঢালি,
কুড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে
দেশলাই দিল জ্বালি।
খোঁড়ার প্রজাটি বাপরে বলিয়া
লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি
কম্পিত পদে চম্পট দিল
একেবারে সভা ছাড়ি।
দুয়ো বলি সবে দেয় করতালি
পিছু পিছু ডাকে "ফেউ"?
কানার অলস বলে কি আপদ
ঘুমুতে দিবিনা কেঊ?
শুনে সবে বলে "ধন্য ধন্য
কুঁড়ে-কুল চুড়ামণি!"
ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল
আগুন হইতে টানি।
কানার লোকের গুণপনা দেখে
কানা রাজা খুসী ভারি,
জমিতে দিলেই আরও দিল কত,
টাকাকড়ি ঘরবাড়ি।

আনন্দ

যে আনন্দ ফুলের বাসে,
যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়,
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দ বাতাস বহে,
যে আনন্দ সাগরজলে,
যে আনন্দ ধুলির কণায়,
যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দ আকাশ ভরা ,
যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি।

বিষম কাণ্ড

কর্তা চলেন, গিন্নী চলেন, খোকাও চলেন সাথে,
তড়্‌বড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শুতে যাচ্ছেন রাতে ।
তেড়ে হন্‌হন্‌ চলে তিনজন যেন পল্টন চলে,
সিঁড়ি উঠ্‌‌তেই, একি কাণ্ড ! এ আবার কি বলে !
ল্যাজ লম্বা, কান গোল্‌ গোল্‌, তিড়িং বিড়িং ছোটে,
চোখ্‌ মিট্‌মিট্‌, কুটুস্‌ কাটুস্‌- এটি কোন্‌জন বটে !
হেই ! হুস্‌ ! হ্যাস্‌ ! ওরে বাস্‌‌রে মতলবখানা কিরে,
করলে তাড়া যায় না তবু, দেখ্‌‌ছে আবার ফিরে ।
ভাবছে বুড়ো, করবো গুঁড়ো ছাতার বাড়ি মেরে,
আবার ভাবে ফস্‌‌কে গেলে কাম্‌‌ড়ে দেবে তেড়ে ।
আরে বাপ্‌‌রে ! বস্‌ল দেখ দুই পায়ে ভর ক'রে,
বুক দুর দুর বুড়ো ভল্লুর, মোমবাতি যায় প'ড়ে ।
ভীষণ ভয়ে দাঁত কপাটি তিন মহাবীর কাঁপে,
গড়িয়ে নামে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে ।

সন্দেশ

সন্দেশের গন্ধে বুঝি দৌড়ে এলে মাছি ?
কেন ভন্‌ ভন্‌ হাড় জ্বালাতন ছেড়ে দাওনা বাঁচি !
নাকের গোড়ায় সুড়্‌সুড়ি দাও শেষটা দিবে ফাঁকি ?
সুযোগ বুঝে সুড়ুৎ ক'রে হুল ফোটাবে নাকি ?

বিষম ভোজ

"অবাক কাণ্ড !" বললে পিসী, "এক চাঙাড়ি মেঠাই এল-
এই ছিল সব খাটের তলায়, এক নিমিষে কোথায় গেল ?"
"সত্যি বটে" বল্‌‌লে খুড়ী, "আনল দু'সের মেঠাই কিনে-
হঠাৎ কোথায় উপ্‌‌সে গেল ? ভেল্কিবাজি দুপুর দিনে ?"
"দাঁড়াও দেখি" বল্‌‌লে দাদা, "করছি আমি এর কিনারা-
কোথায় গেল পট্‌লা ট্যাঁপা- পাচ্ছিনে যে তাদের সাড়া ?"
পর্দাঘেরা আড়াল দেওয়া বারান্দাটার ঐ কোণেতে
চল্‌ছে কি সব ফিস্‌ ফিস্‌ ফিস্‌ শুনল দাদা কানটি পেতে ।
পট্‌লা ট্যাঁপা ব্যস্ত দুজন টপ্‌টপাটপ্‌ মিঠাই ভোজে,
হঠাৎ দেখে কার দুটো হাত এগিয়ে তাদের কানটি খোঁজে ।
কানের উপর প্যাঁচ্‌ ঘোরাতেই দুচোখ বেয়ে অশ্রু ছোটে,
গিল্‌‌বে কি ছাই মুখের মিঠাই, কান বুঝি যায় টানের চোটে ।
পটলবাবুর হোম্‌রা গলা মিল্‌ল ট্যাঁপার চিকন সুরে
জাগ্‌ল করুণ রাগরাগিণী বিকট তানে আকাশ জুড়ে ।

সম্পাদকের দশা

সম্পাদকীয়-
একদা নিশীথে এক সম্পাদক গোবেচারা ।
পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি হইলেন দেশছাড়া ।।
অনাহারী সম্পাদকী হাড়ভাঙা খাটুনি সে ।
জানে তাহা ভুক্তভোগী অপরে বুঝিবে কিসে ?
লেখক পাঠক আদি সকলেরে দিয়া ফাঁকি ।
বেচারী ভাবিল মনে- বিদেশে লুকায়ে থাকি ।।
এদিকে ত ক্রমে ক্রমে বৎসরেক হল শেষ ।
'নোটিশ' পড়িল কত 'সম্পাদক নিরুদ্দেশ' ।।
লেখক পাঠকদল রুষিয়া কহিল তবে ।
জ্যান্ত হোক মৃত হোক ব্যাটারে ধরিতে হবে ।।
বাহির হইল সবে শব্দ করি 'মার মার' ।
-দৈবের লিখন, হায়, খণ্ডাইতে সাধ্য কার ।।
একদা কেমনি জানি সম্পাদক মহাশয় ।
পড়িলেন ধরা- আহা দুরদৃষ্ট অতিশয় ।।
তারপরে কি ঘটিল কি করিল সম্পাদক ।
সে সকল বিবরণে নাহি তত আবশ্যক ।।
মোট কথা হতভাগ্য সম্পাদক অবশেষে ।
বসিলেন আপনার প্রাচীন গদিতে এসে ।।
(অর্থাৎ লেখকদল লাঠৌষধি শাসনেতে ।
বসায়েছে তারে পুনঃ সম্পাদকী আসনেতে ।।)
ঘুচে গেছে বেচারীর ক্ষণিক সে শান্তি সুখ ।
লেখকের তাড়া খেয়ে সদা তার শুষ্কমুখ ।।
দিস্তা দিস্তা পদ্য গদ্য দর্শন সাহিত্য প'ড়ে ।
পুনরায় বেচারির নিত্যি নিত্যি মাথা ধরে ।।
লোলচর্ম অস্থি সার জীর্ণ বেশ রুক্ষ্ণ কেশ ।
মুহূর্ত সোয়াস্তি নাই- লাঞ্ছনার নাহি শেষ ।।

ছবি ও গল্প

ছবির টানে গল্প লিখি নেইক এতে ফাঁকি
যেমন ধারা কথায় শুনি হুবহু তাই আঁকি ।

পরীক্ষাতে গোল্লা পেয়ে
হাবু ফেরেন বাড়ি
চক্ষু দুটি ছানাবড়া
মুখখানি তার হাঁড়ি
রাগে আগুন হলেন বাবা
সকল কথা শুনে
আচ্ছা ক'রে পিটিয়ে তারে
দিলেন তুলো ধুনে
মারের চোটে চেঁচিয়ে বাড়ি
মাথায় ক'রে তোলে
শুনে মায়ের বুক ফেটে যায়
'হায় কি হল' ব'লে
পিসী ভাসেন চোখের জলে
কুট্‌নো কোটা ফেলে
আহ্লাদেতে পাশের বাড়ি
আটখানা হয় ছেলে ।

বুঝবার ভুল

এমনি পড়ায় মন বসেছে, পড়ার নেশায় টিফিন ভোলে ।
সাম্‌নে গিয়ে উৎসাহ দেই মিষ্টি দুটো বাক্য বলে ।
পড়ছ বুঝি ? বেশ বেশ বেশ ! এক মনেতে পড়লে পরে
"লক্ষ্মীছেলে - সোনার ছেলে" বলে সবাই আদর করে ।
এ আবার কি ? চিত্র নাকি ? বাঁদর পাজি লক্ষ্মীছাড়া-
আমায় নিয়ে রংতামাসা ! পিটিয়ে তোমায় কর্‌ছি খাড়া ।

কিছু চাই ?

কারোর কিছু চাই গো চাই ?
এই যে খোকা, কি নেবে ভাই ?
জলছবি আর লাট্টু লাটাই
কেক বিস্কুট লাল দেশলাই
খেলনা বাঁশি কিংবা ঘুড়ি
লেড্‌ পেনসিল রবার ছুরি ?
এসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই ?

কারোর কিছু চাই গো চাই ?
বৌমা কি চাও শুনতে পাই ?
ছিটের কাপড় চিকন লেস্‌
ফ্যান্সি জিনিস ছুঁচের কেস্‌
আল্‌তা সিঁদুর কুন্তলীন
কাঁচের চুড়ি বোতাম পিন্‌ ?
আমার কাছে ওসব নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই ?

কারোর কিছু চাই গো চাই ?
আপনি কি চান কর্তামশাই ?
পকেট বই কি খেলার তাস
চুলের কলপ জুতোর ব্রাশ্‌
কলম কালি গঁদের তুলি
নস্যি চুরুট সুর্তি গুলি ?
ওসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই ?

ছুটি

ঘুচবে জ্বালা পুঁথির পালা ভাবছি সারাক্ষণ-
পোড়া স্কুলের পড়ার পরে আর কি বসে মন ?
দশটা থেকেই নষ্ট খেলা, ঘণ্টা হতেই শুরু
প্রাণটা করে 'পালাই পালাই' মনটা উড়ু উড়ু-
পড়ার কথা খাতায়, পাতায়, মাথায় নাহি ঢোকে !
মন চলে না- মুখ চলে যায় আবোলতাবোল ব'কে !
কানটা ঘোরে কোন্‌ মুলুকে হুঁশ থাকে না তার,
এ কান দিয়ে ঢুকলে কথা, ও কান দিয়ে পার ।
চোখ থাকে না আর কিছুতেই, কেবল দেখে ঘড়ি ;
বোর্ডে আঁকা অঙ্ক ঠেকে আঁচড়কাটা খড়ি ।
কল্পনাটা স্বপ্নে চ'ড়ে ছুটছে মাঠে ঘাটে-
আর কি রে মন বাঁধন মানে ? ফিরতে কি চায় পাঠে ?
পড়ার চাপে ছট্‌ফটিয়ে আর কিরে দিন চলে ?
ঝুপ্‌ ক'রে মন ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ ছুটির বন্যাজলে ।

আয়রে আলো আয়

পুব গগনে রাত পোহাল,
ভোরের কোণে লাজুক আলো
নয়ন মেলে চায় ।
আকাশতলে ঝলক জ্বলে,
মেঘের শিশু খেলার ছলে
আলোক মাখে গায় ।।
সোনার আলো, রঙিন্‌ আলো,
স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো-
আয়রে আলো আয় ।
আয়রে নেমে আঁধার পরে,
পাষাণ কালো ধৌত ক'রে
আলোর ঝরণায় ।।
ঘুম ভাঙান পাখির তানে
জাগ্‌রে আলো আকুল গানে
আকূল নীলিমায় ।
আলসভরা আঁখির কোণে,
দুঃখ ভয়ে আঁধার মনে,
আয়রে আলো আয় ।।

আলোছায়া

হোক্‌না কেন যতই কালো
এমন ছায়া নাইরে নাই-
লাগ্‌লে পরে রোদের আলো
পালায় না যে আপ্‌নি ভাই !..

শুষ্কমুখে আঁধার ধোঁয়া
কঠিন হেন কোথায় বল্‌,
লাগ্‌লে যাতে হাসির ছোঁয়া
আপ্‌নি গলে হয় না জল ।।

বেজায় রাগ

ও হাড়্‌গিলে, হাড়্‌গিলে ভাই, খাপ্পা বড্ড আজ !
ঝগড়া কি আর সাজে তোমার ? এই কি তোমার যোগ্য কাজ ?
হোম্‌রা চোম্‌রা মান্য তোমরা বিদ্যেবুদ্ধি মর্যাদায়
ওদের সঙ্গে তর্ক করছ- নাই কি কোন লজ্জা তায় ?
জান্‌ছ নাকি বলছে ওরা ? "কিচির মিচির কিচ্চিরি,"
অর্থাৎ কিনা, তোমার নাকি চেহারাটা বিচ্ছিরি !
বল্‌ছে আচ্ছা বলুক, তাতে ওদেরই তো মুখ ব্যথা,
ঠ্যাঁটা লোকের শাস্তি যত, ওরাই শেষে ভুগবে তা ।
ওরা তোমায় খোঁড়া বল্‌ছে ? বেয়াদব তো খুব দেখি !
তোমার পায়ে বাতের কষ্ট- ওরা সেসব বুঝবে কি ?
তাই বলে কি নাচবে রাগে ? উঠ্‌বে চটে চট্‌ ক'রে ?
মিথ্যে আরো ত্যাক্ত হবে ওদের সাথে টক্করে ।
ঐ শোন কি বলছে আবার, কচ্ছে কত বক্তৃতা-
বলছে তোমার ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢালবে- সত্যি তা ?
চড়াই পাখির বড়াই দেখ তোমায় দিচ্ছে টিট্‌কিরি-
বল্‌ছে, তোমার মিষ্টি গলায় গান ধরতে গিট্‌কিরি ।
বল্‌ছে, তোমার কাঁথাটাকে 'রিফুকর্ম' করবে কি ?
খোঁড়া ঠ্যাঙে নামবে জলে ? আর কোলা ব্যাঙ করবে কি ?
আর চ'টো না, আর শুনো না, ঠ্যাঁটা মুখের টিপ্পনি,
ওদের কথায় কান দিতে নেই, স'রে পড় এক্ষনি ।

আজব খেলা

সোনার মেঘে আল্‌তা ঢেলে সিঁদুর মেখে গায়
সকাল সাঁঝে সূর্যি মামা নিত্যি আসে যায় ।
নিত্যি খেলে রঙের খেলা আকাশ ভ'রে ভ'রে
আপন ছবি আপনি মুছে আঁকে নূতন ক'রে ।
ভোরের ছবি মিলিয়ে দিল দিনের আল জ্বেলে
সাঁঝের আঁকা রঙিন ছবি রাতের কালি ঢেলে ।
আবার আঁকে আবার মোছে দিনের পরে দিন
আপন সাথে আপন খেলা চলে বিরামহীন ।
ফুরায় নাকি সোনার খেলা ? রঙের নাহি পার ?
কেউ কি জানে কাহার সাথে এমন খেলা তার ?
সেই খেলা, যে ধরার বুকে আলোর গানে গানে
উঠ্‌ছে জেগে- সেই কথা কি সুর্যিমামা জানে ?

বাবু

অতি খাসা মিহি সূতি
ফিনফিনে জামা ধুতি,
চরণে লপেটা জুতি জরিদার ।
এ হাতে সোনার ঘড়ি,
ও হাতে বাঁকান ছড়ি,
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার ।
চক্‌চকে চুল ছাঁটা
তায় তোফা টেরিকাটা-
সোনার চশমা আঁটা নাসিকায় ।
ঠোঁট দুটি এঁকে বেঁকে
ধোঁয়া ছাড়ে থেকে থেকে,
হালচাল দেখে দেখে হাসি পায় ।

ঘোষেদের ছোট মেয়ে
পিক্‌ ফেলে পান খেয়ে,
নিচু পানে নাহি চায় হায়রে ।
সেই পিক থ্যাপ ক'রে
লেগেছে চাদর ভরে
দেখে বাবু কেঁদে মরে যায়রে ।
ওদিকে ছ্যাকরাগাড়ি
ছুটে চলে তাড়াতাড়ি
ছিট্‌কিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ঘোলাজল ।
সহসা সে জল লাগে
জামার পিছন বাগে,
বাবু করে মহারাগে কোলাহল ।।

আবোল তাবোল

এক যে ছিল রাজা- (থুড়ি,
রাজা নয় সে ডাইনি বুড়ি) !
তার যে ছিল ময়ূর- (না না,
ময়ূর কিসের ? ছাগল ছানা) ।
উঠানে তার থাক্‌ত পোঁতা-
-(বাড়িই নেই, তার উঠান কোথা) ?
শুনেছি তাত পিশতুতো ভাই-
-(ভাই নয়ত, মামা-গোঁসাই ) ।
বল্‌ত সে তার শিষ্যটিরে-
-(জন্ম-বোবা বলবে কিরে) ।
যা হোক, তারা তিনটি প্রানী-
-(পাঁচটি তারা, সবাই জানি !)
থও না বাপু খ্যাঁচাখেচি
-(আচ্ছা বল, চুপ করেছি) ।।
তারপরে যেই সন্ধ্যাবেলা,
যেম্নি না তার ওষুধ গেলা,
অম্‌নি তেড়ে জটায় ধরা-
-(কোথায় জটা ? টাক যে ভরা !)
হোক্‌ না টেকো তোর তাতে কি ?
গোমরামুখো মুখ্যু ঢেঁকি !
ধরব ঠেসে টুটির পরে
পিট্‌ব তোমার মুণ্ডু ধরে ।
এখন বাপু পালাও কোথা ?
গল্প বলা সহজ কথা ?

বেজায় খুশি

বাহবা বাবুলাল ! গেলে যে হেসে !
বগলে কাতুকুতু কে দিল এসে ?
এদিকে মিটিমিটি দেখ কি চেয়ে ?
হাসি যে ফেটে পড়ে দু'গাল বেয়ে !
হাসে যে রাঙা ঠোঁট দন্ত মেলে
চোখের কোণে কোণে বিজলী খেলে ।
হাসির রসে গ'লে ঝরে যে লালা
কেন এ খি-খি-খি-খি হাসির পালা ?
যে দেখে সেই হাসে হাহাহা হাহা
বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা !

আদুরে পুতুল

যাদুরে আমার আদুরে গোপাল, নাকটি নাদুস থোপ্‌না গাল,
ঝিকিমিকি চোখ মিট্‌মিটি চায়, ঠোঁট দুটি তায় টাট্‌কা লাল ।
মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক্‌ দাঁত মেলে আর চুল খুলে-
টিনের পুতুল চীনের পুতুল কেউ কি এমন তুলতুলে ?
গোব্‌দা গড়ন এমনি ধরন আব্‌দারে কেউ ঠোঁট ফুলোয় ?
মখমলি রং মিষ্টি নরম- দেখ্‌ছ কেমন হাত বুলোয় !
বল্‌বি কি বল্‌ হাব্‌লা পাগল আবোল তাবোল কান ঘেঁষে,
ফোক্‌লা গদাই যা বলবি তাই ছাপিয়ে পাঠাই "সন্দেশে" ।

মেঘের খেয়াল

আকাশের ময়দানে বাতাসের ভরে,
ছোট বড় সাদা কালো কত মেঘ চরে ।
কচি কচি থোপা থোপা মেঘেদের ছানা
হেসে খেলে ভেসে যায় মেলে কচি ডানা ।
কোথা হতে কোথা যায় কোন্‌ তালে চলে,
বাতাসের কানে কানে কত কথা বলে ।
বুড়ো বুড়ো ধাড়ি মেঘ ঢিপি হয়ে উঠে-
শুয়ে ব'সে সভা করে সারাদিন জুটে ।
কি যে ভাবে চুপ্‌চাপ, কোন ধ্যানে থাকে,
আকাশের গায়ে গায়ে কত ছবি আঁকে ।
কত আঁকে কত মোছে, কত মায়া করে,
পলে পলে কত রং কত রূপ ধরে ।
জটাধারী বুনো মেঘ ফোঁস ফোঁস ফোলে,
গুরুগুরু ডাক ছেড়ে কত ঝড় তোলে ।
ঝিলিকের ঝিকিমিকি চোখ করে কানা,
হড়্‌ হড়্‌ কড়্‌ কড়্‌ দশদিকে হানা ।
ঝুল্‌ কালো চারিধার, আলো যায় ঘুচে,
আকাশের যত নীল সব দেয় মুছে ।

দাদা গো দাদা

দাদা গো দাদা, সত্যি তোমার সুরগুলো খুব খেলে !
এম্‌‌নি মিঠে- ঠিক যেন কেউ গুড় দিয়েছে ঢেলে !
দাদা গো দাদা, এমন খাসা কণ্ঠ কোথায় পেলে?-
এই খেলে যা ! গান শোনাতে আমার কাছেই এলে ?
দাদা গো দাদা, পায়ে পড়ি তোর, ভয় পেয়ে যায় ছেলে-
গাইবে যদি ঐখেনে গাও, ঐ দিকে মুখ মেলে ।

শিশুর দেহ

চশমা-আঁটা পণ্ডিতে কয় শিশুর দেহ দেখে-
"হাড়ের পরে মাংস দিয়ে, চামড়া দিয়ে ঢেকে,
শিরার মাঝে রক্ত দিয়ে, ফুসফুসেতে বায়ু,
বাঁধল দেহ সুঠাম করে পেশী এবং স্নায়ু ।"
কবি বলেন, "শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি,
উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি ।
হাসিতে তার চাঁদের আলো, পাখির কলকল,
অশ্রুকণা ফুলের দলে শিশির ঢলঢল ।"
মা বলেন, "এই দুরুদুরু মোর বুকেরই বাণী,
তারি গভীর ছন্দে গড়া শিশুর দেহখানি ।
শিশুর প্রাণে চঞ্চলতা আমার অশ্রুহাসি,
আমার মাঝে লুকিয়েছিল এই আনন্দরাশি ।
গোপনে কোন্‌ স্বপ্নে ছিল অজানা কোন আশা,
শিশুর দেহে মূর্তি নিল আমার ভালবাসা ।"

কানে খাটো বংশীধর

কানে খাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি,
গুনগুন গান গায় আর নাড়ে দাড়ি ।।
চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর,
সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর ।।
বংশীধর বলে, "আহা, না জানি কি পাখি
সুদুরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি ।।
দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি,
কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি ।।"
এদিকে বেড়াল ভাবে, "এযে বড় দায়,
প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায় ।।
গলা ছেড়ে এত চেঁচামেচি এত করি হায়
তব যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায় ।।
আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি,
যা থাকে কপালে, দেই এক থাবা মারি ।।"
বংশীধর ভাবে, "একি ! বেসুরা যে করে,
গলা গেছে ভেঙে তাই "ফ্যাঁস্‌" সুর ধরে ।।"
হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি,
একেবারে সব গান করে দিল মাটি ।

বর্ষ গেল বর্ষ এল

বর্ষ গেল বর্ষ এল গ্রীষ্ম এলেন বাড়ি-
পৃথ্বী এলেন চক্র দিয়ে এক বছরের পাড়ি ।
সত্যিকারের এই পৃথিবীর বয়স কেবা জানে,
লক্ষ হাজার বছর ধরে চল্‌ছে একই টানে ।
আপন তালে আকাশ পথে আপনি চলে বেগে,
গ্রীষ্মকালের তপ্তরোদে বর্ষাকালের মেঘে,
শরৎকালের কান্নাহাসি হাল্কা বাদল হাওয়া,
কুয়াশা-ঘেরা পর্দা ফেলে হিমের আসা যাওয়া-
শীতের শেষে রিক্ত বেশে শূন্য করে ঝুলি,
তার প্রতিশোধ ফুলে ফলে বসন্তে লয় তুলি ।
না জানি কোন নেশার ঝোঁকে যুগযুগান্ত ধরে,
ছয়টি ঋতু দ্বারে দ্বারে পাগল হয়ে ঘোরে !
না জানি কোন ঘূর্ণীপাকে দিনের পর দিন,
এমন ক'রে ঘোরায় তারে নিদ্রাবিরামহীন !
কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম রাখে লক্ষযুগের প্রথা,
না জানি তার চাল চলনের হিসাব রাখে কোথা !

মেঘ

সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে-
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে ।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে ।
সন্ধ্যা সকাল মেঘের মেলা- কুলকিনারা ছাড়ি
রং বেরঙের পাল তুলে দেয় দেশবিদেশে পাড়ি ।
মাথায় জটা, মেঘের ঘটা আকাশ বেয়ে ওঠে,
জোছনা রাতে চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে ।
কোন্‌ অকুলের সন্ধানেতে কোন্‌ পথে যায় ভেসে-
পথহারা কোন্‌ গ্রামের পরে নাম-জানা-নেই-দেশে ।
ঘূর্ণীপথের ঘোরের নেশা দিক্‌বিদিকে লাগে,
আগল ভাঙা পাগল হাওয়া বাদল রাতে জাগে ;
ঝড়ের মুখে স্বপন ছুটে আঁধার আসে ঘিরে !
মেঘের প্রাণে চমক হানে আকাশ চিরে চিরে !
বুকের মাঝে শঙ্খ বাজে- দুন্দুভি দেয় সাড়া !
মেঘের মরণ ঘনিয়ে নামে মত্ত বাদল ধারা ।

মূর্খমাছি

মাকড়সা
সান্‌-বাঁধা মোর আঙিনাতে
জাল বুনেছি কালকে রাতে,
ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা ।
আয় না মাছি আমার ঘরে,
আরাম পাবি বসলে পরে,
ফরাশ পাতা দেখবি কেমন খাসা !

মাছি

থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌ আর বলে না,
আন্‌কথাতে মন গলে না-
ব্যবসা তোমার সবার আছে জানা ।
ঢুক্‌‌লে তোমার জালের ঘেরে
কেউ কোনদিন আর কি ফেরে ?
বাপ্‌‌রে ! সেথায় ঢুক্‌‌তে মোদের মানা ।

মাকড়সা

হাওয়ায় দোলে জালের দোলা
চারদিকে তার জান্‌লা খোলা
আপ্‌নি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে !
আয় না হেথা হাত পা ধুয়ে
পাখ্‌না মুড়ে থাক্‌ না শুয়ে-
ভন্‌ ভন্‌ ভন্‌ মরবি কেন উড়ে ?

মাছি

কাজ নেই মোর দোলায় দুলে,
কোথায় তোমার কথায় ভুলে
প্রাণটা নিয়ে টান্‌ পড়ে ভাই শেষে ।
তোমার ঘরে ঘুম যদি পায়
সে ঘুম কভু ভাঙবে না হায়-
সে ঘুম নাকি এমন সর্বনেশে !

মাকড়সা

মিথ্যে কেন ভাবিস্‌ মনে ?
দেখ্‌না এসে ঘরের কোণে
ভাঁড়ার ভরা খাবার আছে কত !
দে-টাপাটপ ফেলবি মুখে
নাচ্‌‌বি গাবি থাক্‌‌বি সুখে
ভাবনা ভুলে বাদ্‌শা-রাজার মতো ।

মাছি
লোভ দেখালেই ভুলবে ভবি,
ভাবছ আমায় তেমনি লোভী !
মিথ্যে দাদা ভোলাও কেন খালি,
করব কি ছাই ভাড়ার দেখে ?
প্রণাম করি আড়াল থেকে-
আজকে তোমার সেই গুড়ে ভাই বালি ।

মাকড়সা

নধর কালো বদন ভরে
রূপ যে কত উপচে পড়ে !
অবাক দেখি মুকুটমালা শিরে !
হাজার চোখে মানিক জ্বলে !
ইন্দ্রধনু পাখার তলে !
ছয় পা ফেলে আয় না দেখি ধীরে ।

মাছি

মন ফুর্‌ফুর্‌ ফুর্তি নাচে-
একটুখানি যাই না কাছে !
যাই যাই যাই- বাপ্‌‌রে একি বাঁধা ।
ও দাদা ভাই রক্ষে কর !
ফাঁদ পাতা এ কেমন তরো ।
পড়ে হাত পা হল বাঁধা ।


দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়

দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়
নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায় ?
এমনি দশাই তার কপালে লেখা ।
কথার পাকে মানুষ মেরে
মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে,
গড় করি তার অনেক তফাৎ থেকে ।

নূতন বৎসর

'নূতন বছর ! নূতন বছর !' সবাই হাঁকে সকাল সাঁঝে
আজকে আমার সূর্যি মামার মুখটি জাগে মনের মাঝে ।
মুস্কিলাসান করলে মামা, উস্কিয়ে তার আগুনখানি,
ইস্কুলেতে লাগ্‌ল তালা, থাম্‌ল সাধের পড়ার ঘানি ।
এক্‌জামিনের বিষম ঠেলা চুক্‌ল রে ভাই ঘুচ্ল জ্বালা,
নূতন সালের নূতন তালে হোক্‌ তবে আস 'হকির' পালা ।
কোন্‌খানে কোন্‌ মেজের কোণে, কলম কানে, চশমা নাকে,
বিরামহারা কোন্‌ বেচারা দেখেন কাগজ, ভয় কি তাঁকে ?
অঙ্কে দিবেন হকির গোলা, শঙ্কা ত নাই তাহার তরে,
তঙ্কা হাজার মিলুক তাঁহার, ডঙ্কা মেরে চলুন ঘরে ।
দিনেক যদি জোটেন খেলায় সাঁঝের বেলায় মাঠের মাঝে,
'গোল্লা' পেয়ে ঝোল্লা ভরে আবার না হয় যাবেন কাজে !
আয় তবে আয়, নবীন বরষ ! মলয় বায়ের দোলায় দুলে,
আয় সঘনে গগন বেয়ে, পাগলা ঝড়ের পালটি তুলে ।
আয় বাংলার বিপুল মাঠে শ্যামল ধানের ঢেউ খেলিয়ে,
আয়রে সুখের ছুটির দিনে আম-কাঁটালের খবর নিয়ে !
আয় দুলিয়ে তালের পাখা, আয় বিছিয়ে শীতল ছায়া,
পাখির নীড়ে চাঁদের হাটে আয় জাগিয়ে মায়ের মায়া ।
তাতুক না মাঠ, ফাটুক না কাঠ, ছুটুক না ঘাম নদীর মত,
জয় হে তোমার, নূতন বছর ! তোমার যে গুণ, গাইব কত ?
পুরান বছর মলিন মুখে যায় সকলের বালাই নিয়ে,
ঘুচ্‌ল কি ভাই মনের কালি সেই বুড়োকে বিদায় দিয়ে ?
নূতন সালে নূতন বলে, নূতন আশায়, নুতন সাজে,
আয় দয়ালের নাম লয়ে ভাই, যাই সকলে যে যার কাজে !

মনের মতন

কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ'ল ভূতের মুলুক খুঁজি ।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্‌ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে ?
আর কি দিব ?- মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান ।

কেন সব কুকুরগুলো

কেন সব কুকুরগুলো খামখা চ্যাঁচায় রাতে ?
কেন বল দাঁতের পোকা থাকেনা ফোক্‌লা দাঁতে ?
পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা, কেন সে কাদের দোষে?-
এস ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে ।

সঙ্গীহারা

সবাই নাচে ফূর্তি করে সবাই করে গান,
একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান ?
দেখ্‌ছ নাকি আমার সাথে সবাই করে আড়ি-
তাইত আমার মেজাজ খ্যাপা মুখটি এমন হাঁড়ি ।
তাও কি হয় ! ঐ যে মাঠে শালিখ পাখি ডাকে
তার কাছে কৈ যাওনিকো ভাই শুধাওনিতো তাকে !
শালিখ পাখি বেজায় ঠ্যাঁটা চেঁচায় মিছিমিছি,
হল্লা শুনে হাড় জ্বলে যায় কেবল কিচিমিচি ।
মিষ্টি সুরে দোয়েল পাখি জুড়িয়ে দিল প্রাণ
তার কাছে কৈ বস্‌লে নাতো শুনলে না তার গান ।
দোয়েল পাখির ঘ্যান্‌ঘ্যানানি আর কি লাগে ভালো ?
যেমন রূপে তেমন গুণে তেমনি আবার কালো ।
রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে,
অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে ?
মাছরাঙা ? তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি
রকম সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি ।
পায়রা ঘুঘু কোকিল চড়াই চন্দনা টুনটুনি
কারে তোমার পছন্দ হয়, সেই কথাটি শুনি !
এই গুলো সব ছ্যাবলা পাখি নেহাৎ ছোট জাত-
দেখলে আমি তফাৎ হাটি অমনি পঁচিশ হাত ।
এতক্ষণে বুঝতে পারি ব্যাপারখানা কি যে-
সবার তুমি খুঁৎ পেয়েছ নিখুঁৎ কেবল নিজে !
মনের মতন সঙ্গী তোমার কপালে নাই লেখা
তাইতে তোমায় কেউ পোঁছে না তাইতে থাক একা ।

নিঃস্বার্থ

গোপ্‌লাটা কি হিংসুটে মা ! খাবার দিলেম ভাগ করে,
বললে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে ।
জ্যাঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, "দুই ভায়েতে খাও" ব'লে-
দশটি ছিল, একটি তাহার চাখতে নিলেম ফাও বলে ।
আর যে ন'টি, ভাগ করে তায়, তিন্‌টে দিলেম গোপ্‌লাকে-
তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে ।
বুঝিয়ে বলি, "কাঁদিস কেন ? তুই যে নেহাত কনিষ্ঠ-
বয়স বুঝে সাম্‌লে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট ।
তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুন্‌তি তাই,
মোদ্দা আমার ছয়খানি হয়, তিন বছরে তিন্‌টি পাই ।"
তাও মানে না, কেবল কাঁদে- স্বার্থপরের শয়তানী-
শেষটা আমায় মেঠাইগুলো খেতেই হল সবখানি ।

শ্রাবণে

জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত-
অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত ।
আকাশের মুখ ঢাকা, ধোঁয়ামাখা চারিধার,
পৃথিবীর ছাত পিটে ঝামাঝম্‌ বারিধার ।
স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায় ।
উৎসব ঘনঘোর উন্মাদ শ্রাবণের
শেষ নাই শেষ নাই বরষার প্লাবনের ।
জলেজলে জলময় দশদিক্‌ টলমল্‌,
অবিরাম একই গান, ঢালো জল ঢালো জল ।
ধুয়ে যায় যত তাপ জর্জর গ্রীষ্মের,
ধুয়ে যায় রৌদ্রের স্মৃতিটুকু বিশ্বের ।
শুধু যেন বাজে কোথা নিঃঝুম ধুক্‌ধুক্‌,
ধরণীর আশাভয় ধরণীর সুখদুখ ।

গ্রীষ্ম

ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম,
খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব !
চোখে যেন দেখি তার ধুলিময় অঙ্গ,
বিকট কুটিলজটে ভ্রুকুটির ভঙ্গ,
রোদে রাঙা দুই আঁখি শুকায়েছে কোটরে,
ক্ষুধার আগুন যেন জ্বলে তার জঠরে !
মনে হয় বুঝি তার নিঃশ্বাস মাত্রে
তেড়ে আসে পালাজ্বর পৃথিবীর গাত্রে !
ভয় লাগে হয় বুঝি ত্রিভুবন ভস্ম-
ওরে ভাই ভয় নাই পাকে ফল শস্য !
তপ্ত ভীষণ চুলা জ্বালি নিজ বক্ষে
পৃথিবী বসেছে পাকে, চেয়ে দেখ চক্ষে,-
আম পাকে, জাম পাকে, ফল পাকে কত যে,
বুদ্ধি যে পাকে কত ছেলেদের মগজে !

বর্ষার কবিতা

কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য,
আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য ।
কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে,
হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে ।
সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে,
ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখখানা ফ্যাকাশে ।
বিনা কাজে ঘরে বাঁধা কেটে যায় বেলাটা,
মাটি হল ছেলেদের ফুটবল খেলাটা ।
আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি,
ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি ।
কোনখানে হাঁটু জল, কোথা ঘন কর্দম-
চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্‌দম ।
ব্যাঙেদের মহাসভা আহ্লাদে গদ্‌গদ্‌,
গান করে সারারাত অতিশয় বদ্‌খদ্‌ ।

বর্ষ শেষ

শুন রে আজব কথা, শুন বলি ভাইরে-
বছরের আয়ু দেখ বেশিদিন নাই রে ।
ফেলে দিয়ে পুরাতন জীর্ণ এ খোলসে
নূতন বরষ আসে, কোথা হতে বল সে !
কবে যে দিয়েছে চাবি জগতের যন্ত্রে,
সেই দমে আজও চলে না জানি কি মন্ত্রে !
পাকে পাকে দিনরাত ফিরে আসে বার বার,
ফিরে আসে মাস ঋতু- এ কেমন কারবার ।
কোথা আসে কোথা যায় নাহি কোন উদ্দেশ,
হেসে খেলে ভেসে যায় কত দূর দূর দেশ ।
রবি যায় শশী যায় গ্রহ তারা সব যায়,
বিনা কাঁটা কম্পাসে বিনা কল কব্জায় ।
ঘুরপাকে ঘুরে চলে, চলে কত ছন্দে,
তালে তালে হেলে দুলে চলে রে আনন্দে ।

নন্দগুপি

হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি,
চোরের মতন নন্দগোপাল চল্‌ছে গুড়ি গুড়ি ?
লুকিয়ে বুঝি মুখোশখানা রাখছে চুপি চুপি ?
আজকে রাতে অন্ধকারে টেরটা পাবেন গুপি !
আয়না হাতে দাঁড়িয়ে গুপি হাসছে কেন খালি ?
বিকট রকম পোশাক করে মাখ্‌ছে মুখে কালি !
এমনি করে লম্ফ দিয়ে ভেংচি যখন দেবে
নন্দ কেমন আঁৎকে যাবে- হাসছে সে তাই ভেবে ।
আঁধার রাতে পাতার ফাঁকে ভূতের মতন কেরে ?
ফন্দি এঁটে নন্দগোপাল মুখোশ মুখে ফেরে !
কোথায় গুপি, আসুক না সে ইদিক্‌ পানে ঘুরে-
নন্দদাদার হুঙ্কারে তার প্রাণটি যাবে উড়ে ।

হেথায় কেরে মূর্তি ভীষণ মুখটি ভরা গোঁফে ?
চিমটে হাতে জংলা গুপি বেড়ায় ঝাড়ে ঝোপে !
নন্দ যখন বাড়ির পথে আসবে গাছের আড়ে,
"মার্‌ মার্‌ মার্‌ কাট্‌রে" বলে পড়বে তাহার ঘাড়ে ।
নন্দ চলেন এক পা দু পা আস্তে ধীরে গতি,
টিপটিপিয়ে চলেন গুপি সাবধানেতে অতি-
মোড়ের মুখে ঝোপের কাছে মার্‌তে গিয়ে উঁকি
দুই সেয়ানে এক্কেবারে হঠাৎ মুখোমুখি !
নন্দ তখন ফন্দি ফাঁদন কোথায় গেল ভুলি
কোথায় গেল গুপির মুখে মার্‌ মার্‌ মার্‌ বুলি ।
নন্দ পড়েন দাঁতকপাটি মুখোশ টুখোশ ছেড়ে
গুপির গায়ে জ্বরটি এল কম্প দিয়ে তেড়ে ।
গ্রামের লোকে দৌড়ে তখন বদ্যি আনে ডেকে,
কেউ বা নাচে কেউ বা কাঁদে রকম সকম দেখে ।
নন্দগুপির মন্দ কপাল এম্‌নি হল শেষে,
দেখ্‌লে তাদের লুটোপুটি সবাই মরে হেসে !

হিতে-বিপরীত

ওরে ছাগল, বল্‌ত আগে

সুড়সুড়িটা কেমন লাগে ?
কই গেল তোর জারিজুরি
লম্ফঝম্ফ বাহাদুরি ।
নিত্যি যে তুই আসতি তেড়ে
শিং নেড়ে আর দাড়ি নেড়ে,
ওরে ছাগল করবি রে কি ?
গুঁতোবি তো আয়না দেখি ।
হাঁ হাঁ হাঁ, এ কেমন কথা ?


এমন ধারা অভদ্রতা !
শান্ত যারা ইতরপ্রাণী,
তাদের পরে চোখরাঙানি !
ঠাণ্ডা মেজাজ কয় না কিছু,
লাগতে গেছ তারই পিছু ?
শিক্ষা তোদের এম্নিতর
ছি-ছি-ছি ! লজ্জা বড় ।


ছাগল ভাবে সামনে একি !
একটুখানি গুঁতিয়ে দেখি ।
গুঁতোর চোটে ধড়াধ্বড়
হুড়মুড়িয়ে ধুলোয় পড় ।
তবে রে পাজি লক্ষ্মীছাড়া
আমার 'পরেই বিদ্যেঝাড়া,
পাত্রাপাত্র নাই কিরে হুঁশ্‌
দে দমাদম ধুপুস্‌ ধাপুস্‌ ।

নিরুপায়

বসি বছরের পয়লা তারিখে
মানের খাতায় রাখিলাম লিখে-
"সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্‌,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক ।"
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি,
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি !
লিখিয়াছে, "যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত কি হবে কাঁদান তাহারে ?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া-
তখন কি করি, আমি নিরুপায় !
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া !"

জীবনের হিসাব

বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন, "বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে ?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে ? জোয়ার কেন আসে ?"
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্‌ফেলিয়ে হাসে ।
বাবু বলেন, "সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি ।

খানিক বাদে কহেন বাবু, "বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেম্‌‌নে আসে পাহাড় হতে নেবে ?
বল্‌ত কেন লবণপোরা সাগরভরা পানি?"
মাঝি সে কয়, "আরে মশাই, অত কি আর জানি ?"
বাবু বলেন, "এই বয়সে জানিসনেও তাকি ?
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি ।"
আবার ভেবে কহেন বাবু, "বলত ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো ?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন ?"
বৃদ্ধ বলে, "আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন ?"
বাবু বলেন, "বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা ।"

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুব্‌ল বুঝি দুলে ।
মাঝিরে কন, "একি আপদ ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুব্‌ল নাকি নৌকা এবার ? মরব নাকি আজি ?"
মাঝি শুধায়, "সাঁতার জানো ?" মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, "মশাই, এখন কেমন কাবু ?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে ।"

লোভী ছেলে

কি ভেবে যে আপন মনে
হাসি আসে ঠোঁটের কোণে,-

আধ আধ ঝাপসা বুলি
কোন কথা কয়না খুলি ।

বসে বসে একলা নিজে
লোভী ছেলে ভাবেন কি যে-

শুধু শুধু চামচ চেটে
মনে মনে সাধ কি মেটে ?

একটুখানি মিষ্টি দিয়ে
রাখ আমায় চুপ করিয়ে,

নইলে পরে চেঁচিয়ে জোরে
তুলব বাড়ি মাথায় ক'রে ।

তেজিয়ান

চলে খচ্‌খচ্‌
ভুরু কট্‌মট্‌
দেখে বাঘ-রাগ
বয়ে লাফ ঝাঁপ
লাথি চার চার
মহা উৎপাত
ঝাড়ুবর্দার
তারি বালতিএ-
রেগে লালমুখে
মারে ঠন্‌ ঠন্‌
পায়ে কাল্‌সিটে
বুঝি ঠাং যায়
রাগে গজ্‌গজ্‌
ছড়ি ফট্‌ফট্‌
লোকে 'ভাগ্‌ ভাগ্‌'
বলে 'বাপ্‌ বাপ্‌'
খেয়ে মার্জার
ক'রে হুটপাট্‌
হারুসর্দার
দেখে ফাল্‌ দিয়ে
হেঁকে গাল রুখে
হাড়ে টন্‌ টন্‌
কেন বালতিতে
খোঁড়া ল্যাংচায়
জুতা মচ্‌মচ্‌ তানে,
লাথি চট্‌পট্‌ হানে ।
করে আগভাগ থেকে,
সরে হাবভাব দেখে ।
ছোটে যার যার ঘরে,
চলে ফুটপাথ্‌ পরে ।
ফেরে ঘরদ্বার ঝেড়ে,
আসে পালটিয়ে তেড়ে
মারে তাল ঠুকে দাপে
মাথা ঝন ঝন কাঁপে
মেরে চাল্‌ দিতে গেলে ?
দেখে ভ্যাংচায় ছেলে ।

সাধে কি বলে গাধা !

বললে গাধা মনের দুঃখে অনেকখানি ভেবে-
"বয়েস গেল খাটতে খাটতে, বৃদ্ধ হলাম এবে,
কেউ না করে তোয়াজ তবু, সংসারের কি রীতি !
ইচ্ছে করে এক্ষুনি দিই কাজে কর্মে ইতি ।
কোথাকার ঐ নোংরা কুকুর, আদর যে তার কত-
যখন তখন ঘুমোচ্ছে সে লাটসাহেবের মত !
ল্যাজ নেড়ে যেই, ঘেউ ঘেউ ঘেউ, লাফিয়ে দাঁড়ায় কোলে,
মনিব আমার বোক্‌চন্দর, আহ্লাদে যান গলে ।
আমিও যদি সেয়ানা হতুম, আরামে চোখ মুদে
রোজ মনিবের মন ভোলাতুম অম্নি নেচে কুঁদে ।
ঠাং নাচাতুম, ল্যাজ দোলাতুম, গান শোনাতুম সাধা-
এ বুদ্ধিটা হয়নি আমার- সাধে কি বলে গাধা !"

বুদ্ধি এঁটে বসল গাধা আহ্লাদে ল্যাজ নেড়ে,
নাচ্‌ল কত, গাইল কত, প্রাণের মায়া ছেড়ে ।
তারপরেতে শেষটা ক্রমে স্ফুর্তি এল প্রাণে
চলল গাধা খোদ্‌ মনিবের ড্রইংরুমের পানে ।
মনিবসাহেব ঝিমুচ্ছিলেন চেয়ারখানি জুড়ে,
গাধার গলার শব্দে হঠাৎ তন্দ্রা গেল উড়ে ।
চম্‌কে উঠে গাধার নাচন যেমনি দেখেন চেয়ে,
হাসির চোটে সাহেব বুঝি মরেন বিষম খেয়ে ।

ভাব্‌লে গাধা- এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে
এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে ।
এই না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে
চড়্‌ল সে তার হাঁটুর উপর দুই পা তুলে চেপে ।
সাহেব ডাকেন 'ত্রাহি ত্রাহি' গাধাও ডাকে 'ঘ্যাঁকো'
(অর্থাৎ কিনা 'কোলে চড়েছি, এখন আমার দ্যাখো !')

ডাক শুনে সব দৌড়ে এল ব্যস্ত হয়ে ছুটে,
দৌড়ে এল চাকর বাকর মিস্ত্রী মজুর মুটে,
দৌড়ে এল পাড়ার লোকে, দৌড়ে এল মালী-
কারুর হাতে ডাণ্ডা লাঠি, কারু বা হাত খালি ।
ব্যাপার দেখে অবাক সবাই, চক্ষু ছানাবড়া-
সাহেব বললে, "উচিত মতন শাসনটি চাই কড়া ।"
হাঁ হাঁ ব'লে ভীষন রকম উঠ্‌ল সবাই চটে
দে দমাদম্‌ মারের চোটে গাধার চমক্‌ ছোটে ।

ছুটল গাধা প্রাণের ভয়ে গানের তালিম ছেড়ে,
ছুটল পিছে একশো লোকে হুড়মুড়িয়ে তেড়ে ।
তিন পা যেতে দশ ঘা পড়ে, রক্ত ওঠে মুখে-
কষ্টে শেষে রক্ষা পেল কাঁটার ঝোপে ঢুকে ।
কাঁটার ঘায়ে চামড়া গেল, সার হল তার কাঁদা ;
ব্যাপার শুনে বললে সবাই, "সাধে কি বলে গাধা !"

হিংসুটিদের গান

আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী,
তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাব মিশ্রী ।
আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাব চম্‌চম্‌,
তোমরা ত তা পাচ্ছ না কেউ, পেলেও পাবে কম কম ।
আমরা শোব খাট্‌ পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষটে,
তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে ।
আমরা যাব জামতাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে,
চেঁচাও যদি "সঙ্গে নে যাও" বল্‌ব "কলা এই নে" !
আমরা ফিরি বুক ফুলিয়ে রঙিন জুতোয় মচ্‌মচ্‌,
তোমরা হাঁদা নোংরা ছিছি হ্যাংলা নাকে ফঁচ্‌ফঁচ্‌ ।
আমরা পরি রেশমি জরি, আমরা পরি গয়না,
তোমরা সেসব পাওনা ব'লে তাও তোমাদের সয় না ।
আমরা হব লাটমেজাজি, তোমরা হব কিপ্‌টে,
চাইবে যদি কিচ্ছু তখন ধরব গলা চিপ্‌টে ।

অবুঝ

চুপ করে থাক্‌, তর্ক করার বদ্‌অভ্যাসটি ভাল না,
এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা ।
দেখ্‌ ত দেখি আজও আমার মনের তেজটি নেভেনি-
এইবার শোন্‌ বলছি এখন- কি বলছিলেম ভেবেনি !
বলছিলেম কি, আমি একটা বই লিখেছি কবিতার,
উঁচু রকম পদ্যে লেখা আগাগোড়াই সবি তার ।
তাইতে আছে "দশমুখে চায়, হজম করে দশোদর,
শ্মশানঘাটে শষ্পানি খায় শশব্যস্ত শশধর ।"
এই কথাটার অর্থ যে কি, ভাবছে না কেউ মোটেও-
বুঝছে না কেউ লাভ হবে কি, অর্থ যদি জোটেও ।
এরই মধ্যে হাই তুলিস্‌ যে ? পুঁতে ফেল্‌ব এখনি,
ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু, ফাঁদ ত বাবা দেখনি !
কি বললি তুই ? সাতান্নবার শুনেছিস্‌ ঐ কথাটা ?
এমন মিথ্যে কইতে পারিস্‌ লক্ষ্মীছাড়া বখাটা !
আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধ্যি নেই কো পেরোবার
হিসেব দেব, বলেছি এই চোদ্দবার কি তেরোবার ।
সাতান্ন তুই গুনতে পারিস্‌ ? মিথ্যেবাদি গুনে যা-
ও শ্যামাদাস ! পালাস্‌ কেন ? রাগ করিনি, শুনে যা।

কাজের লোক

প্রথম: বাঃ- আমার নাম 'বাঃ',
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা !
লেখাপড়ার ধার ধারিনে, বছর ভরে ছুটি,
হেসে খেলে আরাম ক'রে দুশো মজা লুটি ।
কারে কবে কেয়ার করি, কিসের করি ডর ?
কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর ।
গাধার মত খাটিস্‌ তোরা মুখটা করে চুন-
আহাম্মুকি কাণ্ড দেখে হেসেই আমি খুন ।

সকলে: আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা,
হাস্‌ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা ।

দ্বিতীয়: 'যদি' বলে ডাকে আমায় নামটি আমার 'যদি'-
আশায় আশায় বসে থাকি হেলান দিয়ে গদি ।
সব কাজেতে থাকত যদি খেলার মত মজা,
লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা-
স্যান্ডো সমান ষণ্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে,
প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে-
উঠে পড়ে লেগে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে ।
করতে পারি সবি- যদি সহজ উপায় মেলে ।

সকলে: হাতের কাছে সুযোগ, তবু 'যদি'র আশায় বসে
নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে ।

তৃতীয়: আমার নাম 'বটে' ! আমি সদাই আছি চটে-
কট্‌মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে ।
চশমা পরে বিচার ক'রে, চিরে দেখাই চুল-
উঠ্‌তে বস্‌তে কচ্ছে সবাই হাজার গণ্ডা ভুল ।
আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার ?
ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার !
হাস্‌ছ ? বটে ! ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক,
একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ ।

সকলে: দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল ?
আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে- নিজের গায়েই ফেল।

চতুর্থঃ আমার নাম 'কিন্তু', আমায় 'কিন্তু' বলে ডাকে,
সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে ।
দশটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি,
ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি ।
লম্ফ ঝম্ফ বহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি-
ফোঁস্‌ ক'রে যাই তেড়ে- আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি ।
পাঁচটা জিনিস গড়্‌তে গেলে, দশটা ভেঙে চুর-
বল্‌ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদূর !

সকলেঃ উচিত তোমায় বেঁধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি,
বেগারখাটা পণ্ডকাজের মূল্য কানাকড়ি ।

পঞ্চমঃ আমার নাম 'তবু', তোমরা কেউ কি আমায় চেনো ?
দেখ্‌তে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো ।
এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে,
যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে ।
এমনি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি,
একুশ বারে না হয় যদি, বাইশ বারে কষি ।
হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে,
হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ'মে ।

সকলেঃ নিষ্কম্মারা গেল কোথা, পালাল কোন দেশে ?
কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে ।
হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়,
সময়টা যে কাজে লাগায়, চালাক বলে তায় ।

নাচের বাতিক

বয়স হল অষ্টাআশি, চিম্‌‌সে গায়ে ঠুন্‌‌কো হাড়,
নাচ্‌‌ছে বুড়ো উল্টোমাথায়- ভাঙলে বুঝি মুণ্ডু ঘাড় !
হেঁইয়ো ব'লে হাত পা ছেড়ে পড়ছে তেড়ে চিৎপটাং,
উঠ্‌‌ছে আবার ঝট্‌পটিয়ে এক্কেবারে পিঠ সটান্‌ ।
বুঝিয়ে বলি, "বৃদ্ধ তুমি এই বয়েসে করছো কি ?
খাও না খানিক মশ্‌লা গুলে হুঁকোর জল আর হর্‌তকী ।
ঠাণ্ডা হবে মাথার আগুন, শান্ত হবে ছট্‌ফটি-"
বৃদ্ধ বলে, "থাম না বাপু, সব তাতে তোর পট্‌পটি !
ঢের খেয়েছি মশ্‌লা পাঁচন, ঢের মেখেছি চর্বি তেল ;
তুই ভেবেছিস আমায় এখন চাল্‌ মেরে তুই করবি ফেল ?"
এই না ব'লে ডাইনে বাঁয়ে লম্ফ দিয়ে হুঁশ ক'রে
হঠাৎ খেয়ে উল্টোবাজি ফেল্‌‌লে আমায় 'পুশ' ক'রে ।


"নাচ্‌‌লে অমন উল্টো রকম," আবার বলি বুঝিয়ে তায়,
"রক্তগুলো হুড়্‌হুড়িয়ে মগজ পানে উজিয়ে যায় ।"
বললে বুড়ো, "কিন্তু বাবা, আসল কথা সহজ এই-
ঢের দেখেছি পরখ করে কোথাও আমার মগজ নেই ।
তাইতো আমার হয় না কিছু- মাথায় যে সব ফক্কিফাঁক-
যতটা নাচি উল্টো নাচন, যতই না খাই চর্কিপাক ।"
বলতে গেলাম, "তাও কি হয়"- অম্নি হঠাৎ ঠাং নেড়ে
আবার বুড়ো হুড়মুড়িয়ে ফেললে আমায় ল্যাং মেরে ।
ভাবছি সবে মারব ঘুঁষি এবার বুড়োর রগ্‌ ঘেঁষে,
বললে বুড়ো, "করব কি বল্‌ ? এ সব করায় অভ্যেসে ।
ছিলাম যখন রেল-দারোগা চড়্‌তে হত ট্রেইনেতে
চলতে গিয়ে ট্রেনগুলো সব পড়ত প্রায়ই ড্রেইনেতে ।
তুব্‌ড়ে যেত রেলের গাড়ি লাগত গুঁতা চাক্কাতে,
ছিট্‌কে যেতাম যখন তখন হঠাৎ এক এক ধাক্কাতে ।
নিত্যি ঘুমাই এক চোখে তাই, নড়লে গাড়ি- অম্নি 'বাপ্‌-
এম্‌নি ক'রে ডিগবাজিতে এক্কেবারে শূন্য লাফ ।
তাইতে হল নাচের নেশা, হঠাৎ হঠাৎ নাচন পায়,
বসতে শুতে আপ্‌নি ভুলে ডিগ্‌বাজি খাই আচম্‌কায় !
নাচতে গিয়ে দৈবে যদি ঠাং লাগে তো পাঁজরাতে,
তাই ব'লে কি চটতে হবে ? কিম্বা রাগে গজ্‌রাতে ?"
আমিও বলি, "ঘাট হয়েছে, তোমার খুরে দণ্ডবৎ !
লাফাও তুমি যেমন খুশি, আমরা দেখি অন্য পথ ।"

আড়ি

কিসে কিসে ভাব নেই ? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে-
বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে ।

শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,
সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী !

আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনদিন্‌ সে ?
কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয় ।

তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখনি ?
ছ্যাঁক্‌ ছ্যাঁক্‌ রাগ যেন খেতে আসে এখনি ।

তার চেয়ে বেশি আড়ি আমি পারি কহিতে-
তোমাদের কারো কারো কেতাবের সহিতে ।

জালা-কুঁজো সংবাদ

পেটমোটা জালা কয়, "হেসে আমি মরিরে
কুঁজো তোর হেন গলা এতটুকু শরীরে !"
কুঁজো কয়, "কথা কস্‌ আপনাকে না চিনে,
ভুঁড়িখানা দেখে তোর কেঁদে আর বাঁচিনে ।"
জালা কয়, "সাগরের মাপে গড়া বপুখান,
ডুবুরিরা কত তোলে তবু জল অফুরান ।"
কুঁজো কয়, "ভালো কথা ! তবে যদি দৈবে,
ভুঁড়ি যায় ভেস্‌‌তিয়ে, জল কোথা রইবে ?"
"নিজ কথা ভুলে যাস্‌ ?" জালা কয় গর্জে,
"ঘাড়ে ধরে হেঁট ক'রে জল নেয় তোর যে !"
কুঁজো কয়, "নিজ পায়ে তবু খাড়া রই তো-
বিঁড়ে বিনা কুপোকাৎ, তেজ তোর ঐতো !"

পরিবেষণ

পরি'পূর্বক 'বিষ'ধাতু তাহে 'অনট্‌' ব'সে
তবে ঘটায় পরিবেষণ, লেখে অমরকোষে ।
-অর্থাৎ ভোজের ভাণ্ড হাতে লয়ে মেলা
ডেলা ডেলা ভাগ করি পাতে পাতে ফেলা ।
এই দিকে এস তবে লয়ে ভোজভাণ্ড
সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড ।
কেহ কহে "দৈ আন" কেহ হাঁকে "লুচি"
কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি ।
হোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে

হাতাহাতি গুঁতাগুঁতি দ্বন্দরণে মাতে ।
কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা-
অনাহারে কতধারে হল প্রাণ হত্যা ।
কোন প্রভু হস্তিদেহ ভুঁড়িখানা ভারি
ঊর্ধ্ব হতে থপ্‌ করি খাদ্য দেন ছাড়ি ।
কোন চাচা অন্ধপ্রায় ('মাইনাস কুড়ি')
ছড়ায় ছোলার ডাল পথঘাট জুড়ি ।
মাতব্বর বৃদ্ধ যায় মুদি চক্ষু দুটি,
"কারো কিছু চাই" বলি তড়বড় ছুটি-
বীরোচিত ধীর পদে এসে দেখি ত্রস্তে-
ওই দিকে খালি পাত, চল হাঁড়ি হস্তে ।
তবে দেখ, খাদ্য দিতে অতিথির থালে
দৈবাৎ না ঢোকে কভু যেন নিজ গালে ।
ছুটোনাকো ওরকম মিছে খালি হাতে
দিও না মাছের মুড়া নিরামিষ পাতে ।
অযথা আক্রোশে কিবা অন্যায় আদরে
ঢেলো না অম্বল কারো নূতন চাদরে ।
বোকাবৎ দন্তপাটি করিয়া বাহির
করোনাকো অকারণ কৃতিত্ব জাহির ।

বিষম চিন্তা

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-
সবাই বলে, "মিথ্যে বাজে বকিস্‌নে আর খবরদার !"
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব ?
বলবে সবাই, "মুখ্যু ছেলে", বলবে আমায় "গো গর্ধভ !"
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর ?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর ?
গাধার কেন শিং থাকেনা, হাতির কেন পালক নেই ?
গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তাধেই ধেই ?
সোডার বোতল খুললে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে ?
কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে ?
ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয় ?
মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন "পাগোল" কয় ?
কতই ভাবি এসব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই ?
বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই ।

খাই খাই

খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে-
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে ।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব, -থাক সেই আশাতে ।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে-
খুঁজে পেতে আনি খেতে- নয় বড় সিধে সে !
জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয়,
জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিও ।
ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা,
জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা ।
ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ) ,
বার্মার 'ঙাম্পি'তে বাপরে কি গন্ধ !
মাদ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কণ্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘণ্ট !
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা ।
দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা ।
তা না হলে কলা খাও, চটো কেন বস না-
সবে হল খাওয়া শুরু, শোন শোন আরো খায়-
সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায় ।
বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে,
খাসা দেখ 'খাপ্‌ খায়' চাপকানে দাড়িতে ।
তেলে জলে 'মিশ খায়', শুনেছ তা কেও কি ?
যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি ?
ডিঙি চড়ে স্রোতে প'ড়ে পাক খায় জেলেরা,
ভয় খেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা ;
বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়,
কেউ খেয়ে থতমত- তাও লিখি তালিকায় ।
ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্‌ নাহি পায় রে-
'দিন আনে দিন খায়' কত লোক হায় রে ।
হোঁচটের চোট খেয়ে খোকা ধরে কান্না,
মা বলেন চুমু খেয়ে, 'সেরে গেছে আর না ।'
ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য,
কিলচড় লাথি ঘুঁষি হয় তার খাদ্য ।
জুতো খায়, গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে,
তবু যদি নুন খায়, সেও গুণ গায় রে ।
গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্‌সিম্‌,
পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্‌ঝিম্‌ ।
কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা,
কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা ।
টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা,
ঘাবড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা ।
আকাশেতে কাৎ হ'য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা,
পালোয়ান খায় দেখ ডিগবাজি কুড়িটা ।
ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা,
কাশিতে প্রসাদ খেয়ে সাধু হই পাক্কা !
কথা শোন, মাথা খাও, রোদ্দুরে যেও না-
আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেও না ।
'ফেল্‌' ক'রে মুখ খেয়ে কেঁদেছিলে সেবারে,
আদা-নুন খেয়ে লাগো, পাশ কর এবারে ।
ভ্যাবাচ্যাকা খেও নাকো, যেয়ো নাকো ভড়কে,
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে ।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা-
খাও তবে কচু পোড়া, খাও তবে ঘণ্টা ।

বেশ বলেছ

এসব কথা শুন্‌‌লে তোদের লাগবে মনে ধাঁধা,
কেউ বা বুঝে পুরোপুরি, কেউ বা বুঝে আধা ।

কারে বা কই কিসের কথা কই যে দফে দফে,
গাছের 'পরে কাঁঠাল দেখে তেল মেখ না গোঁফে ।

একটি একটি কথায় যেন সদ্য দাগে কামান,
মন-বসনের ময়লা ধুতে তত্ত্বকথাই সমান ।

বেশ বলেছ, ঢের বলেছ, ঐখেনে দাও দাঁড়ি,
হাঁটের মাঝে ভাঙবে কেন বিদ্যে বোঝাই হাঁড়ি !

খুচরো ছড়া

মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি
নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্-
হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাগের বাসায় বগের ডিম ॥
––––––––
বল্‌ব কি ভাই হুগ্‌‌লি গেলুম,
বল্‌‌ছি তোমায় চুপি চুপি-
দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর
মাথায় তাদের নেইকো টুপি॥
––––––––
আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে,
দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে;
তাই দেখে খুঁতধরা বুড়ো কয় চটে,
দেখছ কি, এই রঙ পাকা নয় মোটে ॥
––––––––
ঢপ্ ঢপ্ ঢাক ঢোল ভপ্ ভপ্ বাঁশি,
ঝন্ ঝন্ করতাল্ ঠন্ ঠন্ কাঁসি ।
ধুমধাম বাপ্ বাপ্ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা,
বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা ॥
––––––––
বাস্‌‌রে বাস্‌‌ ! সাবাস্‌‌ বীর !
ধনুকখানি ধ'রে,
পায়রা দেখে মারলে তীর-
কাগ্‌‌টা গেল ম্'রে !
শুনেছ কি ব'লে গেল সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টক্‌টক্ গন্ধ?
টক্‌টক্ থাকে নাকো হ'লে পরে বৃষ্টি-
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি ।
––––––––
কহ ভাই কহ রে, ‌অ্যাঁকাচোরা শহরে,
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে,
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না!
––––––––
শোন শোন গল্প শোন, `এক যে ছিল গুরু,'
এই আমার গল্প হল শুরু ।
যদু আর বংশীধর যমজ ভাই তারা,
এই আমার গল্প হল সারা ।
––––––––
বল্‌‌ছি, ওরে ছাগল ছানা,
উড়িস্‌‌নে রে উড়িস্‌‌নে।
জানিস্‌‌নে তোর উড়তে মানা-
হাত পাগুলো ছুড়িস্‌‌নে।
––––––––
খিল্‌‌খিল্লির মুল্লুকেতে থাকত নাকি দুই বেড়াল,
একটা শুধায় আরেকটাকে, "তুই বেড়াল না মুই বেড়াল?"
তাই থেকে হয় তর্ক শুরু, চীৎ‌কারে তার ভূত পালায়,
আঁচড় কামড় চর্কিবাজী ধাঁই চটাপট চড় চালায় ।
খাম্‌‌চা খাবল ডাইনে বাঁয়ে হুড়মুড়িয়ে হুলোর মতো,
উড়ল রোঁয়া চারদিকেতে রাম্-ধুনুরীর তুলোর মতো ।
তর্ক যখন শন্ত হল, ক্ষান্ত হল আঁচড় দাগা,
থাকত দুটো আস্ত বেড়াল, র‌‌ইল দুটো ল্যাজের ডগা ।

বুড়ীর বাড়ী

গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,
ঝুরঝুরে প'ড়ো ঘরে থুরথুরে বুড়ী ।
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো,
মিট্‌‌মিটে ঘোলা চোখ, পিঠখানা কুলো ।
কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর - আঁঠা দিয়ে সেঁটে,
সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে ।
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক্‌ খক্‌ কাশি দিলে ঠক্‌ ঠক্‌ নড়ে ।
ডাকে যদি ফিরিওলা হাঁকে যদি গাড়ি,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী ।
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
ঝাঁট, দিলে ঝ'রে পড়ে কাঠকুটো যত ।
ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্‌লায় ভিজে,
একা বুড়ী কাঠি গুজে ঠেকা দেয় নিজে ।
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি,
থুরথুরে বুড়ী তার ঝুরঝুরে বাড়ী ।