আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল! টিফিনের ছুটি হওয়ামাত্র আমরা সকলেই মহা উত্সাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল `পাগলা দাশু'।
পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু, রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না--- দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত! আমরা রামপদকে বলিলাম, ``দাশুকে কিছু দে!'' রামপদ বলিল, ``কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস, খাবার লোভ হয়ে থাকে তো বল আর আমার সঙ্গে কোনোদিন লাগতে আসবি নে--- তা হলে মিহিদানা পাবি।'' এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তার পর দরোয়ানের কুকুরটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল! তার পর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া কি যেন ভাবিয়া মুচ্কি মুচ্কি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল। এদিকে হাঁড়িটাকে শেষ করিয়া আমরা সকলে খেলায় মাতিয়া গেলাম--- দাশুর কথা কেউ আর ভাবিবার সময় পাই নাই।
টিফিনের পর ক্লাশে আসিয়া দেখি দাশু অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে এককোণে বসিয়া আপন মনে অঙ্ক কষিতেছে। তখনই আমাদের কেমন সন্দেহ হইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ``কি রে দাশু, কিছু করেছিস নাকি?'' দাশু অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো বলিল, ``হ্যাঁ, দুটো জি-সি-এম করে ফেলেছি।'' আমরা বলিলাম, ``দুত্! সে কথা কে বলছে? কিছু দুষ্টুমির মতলব করিস নি তো?'' এ কথায় দাশু ভয়ানক চটিয়া গেল। তখন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশে আসিতেছিলেন, দাশু তাঁহার কাছে নালিশ করে আর কি! আমরা অনেক কষ্টে তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিলাম।
এই পণ্ডিতমহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন। পড়ার জন্য কোনোদিনই তাড়াহুড়া করেন না। কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাত্ সাংঘাতিকরকম চটিয়া যান। সে সময় তাঁর মেজাজটি আশ্চর্যরকম ধারালো হইয়া উঠে। পণ্ডিতমহাশয় চেয়ারে বসিয়াই, ``নদী শব্দের রূপ কর'' বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া, হড়্বড়্ করিয়া যা তা খানিকটা বলিয়া গেলাম--- এবং তাহার উত্তরে পণ্ডিতমহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্ঘড়্ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া `টুকটাক্' আর `দশ-পঁচিশ' খেলা শুরু করিলাম। কেবল মাঝে মাঝে যখন ঘড়্ঘড়ানি কমিয়া আসিত--- তখন সবাই মিলিয়া সুর করিয়া `নদী নদ্যৌ নদ্যঃ' ইত্যাদি আওড়াইতাম। দেখিতাম, তাহাতে ঘুমপাড়ানি গানের ফল খুব আশ্চর্যরকম পাওয়া যায়।
সকলে খেলায় মত্ত, কেবল দাশু এককোনায় বসিয়া কি যেন করিতেছে--- সেদিকে আমাদের কোনো খেয়াল নাই। একটু বাদে পণ্ডিতমহাশয়ের চেয়ারের তলায় তক্তার নীচ হইতে `ফট্' করিয়া কি একটা আওয়াজ হইল। পণ্ডিতমহাশয় ঘুমের ঘোরে ভ্রূকুটি করিয়া সবেমাত্র `উঁঃ' বলিয়া কি যেন একটা ধমক দিতে যাইবেন, এমন সময় ফুট্ফাট্, দুম্দাম্, ধুপ্ধাপ্ শব্দে তাণ্ডব কোলাহল উঠিয়া সমস্ত স্কুলটিকে একেবারে কাঁপাইয়া তুলিল। মনে হইল যেন যত রাজ্যের মিস্ত্রি-মজুর সবাই একজোটে বিকট তালে ছাত পিটাইতে লাগিয়াছে--- দুনিয়ার কাঁসারি আর লাঠিয়াল সবাই যেন পাল্লা দিয়ে হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকিতেছে। খানিকক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যাহাকে পড়ার বইয়ে `কিংকর্তব্যবিমূঢ়' বলে, তেমনি হইয়া হাঁ করিয়া রহিলাম। পণ্ডিতমহাশয় একবার মাত্র বিকট শব্দ করিয়া তার পর হঠাত্ হাত-পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙাইয়া একেবারে ক্লাশের মাঝখানে ধড়্ফড়্ করিয়া পড়িয়া গেলেন। সরকারি কলেজের নবীন পাল বরাবর `হাইজাম্পে' ফার্স্ট প্রাইজ পায়; তাহাকেও আমরা এরকম সাংঘাতিক লাফাইতে দেখি নাই। পাশের ঘরে নীচের ক্লাশের ছেলেরা চীত্কার করিয়া `কড়াকিয়া' মুখস্থ আওড়াইতেছিল--- গোলমালে তারাও হঠাত্ আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে স্কুলময় হুলস্থূল পড়িয়া গেল--- দরোয়ানের কুকুরটা পর্যন্ত যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া বিকট কেঁউ কেঁউ শব্দে গোলমালের মাত্রা ভীষণরকম বাড়াইয়া তুলিল।
পাঁচ মিনিট ভয়ানক আওয়াজের পর যখন সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, ``কিসের শব্দ হইয়াছিল দেখ।'' দরোয়ানজি একটা লম্বা বাঁশ দিয়া অতি সাবধানে, আস্তে আস্তে তক্তার নীচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল--- রামপদর সেই হাঁড়িটা; তখনো তার মুখের কাছে একটু মিহিদানা লাগিয়াছিল। পণ্ডিতমহাশয় ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, ``এ হাঁড়ি কার?'' রামপদ বলিল, ``আজ্ঞে, আমার।'' আর কোথা যায়--- অমনি দুই কানে দুই পাক! ``হাঁড়িতে কি রেখেছিলি?'' রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহারই ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে! সে বেচারা তাড়াতাড়ি বুঝাইতে গেল, ``আজ্ঞে, ওর মধ্যে করে মিহিদানা এনেছিলাম, তার পর''--- মুখের কথা শেষ না হইতেই পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, ``তার পর মিহিদানাগুলো চীনে পটকা হয়ে ফুটতে লাগল--- না?'' বলিয়াই ঠাস্ ঠাস্ করিয়া দুই চড়!
অন্যান্য মাস্টাররাও ক্লাশে আসিয়া জড়ো হইয়াছিলেন; তাঁহারা একবাক্যে হাঁ হাঁ করিয়া রুখিয়া আসিলেন। আমরা দেখিলাম বেগতিক। বিনা দোষে রামপদ বেচারা মার খায় বুঝি! এমন সময় দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, ``এই দেখুন, আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা কচ্ছিল--- এই দেখুন, টুকটাকের ঘর কাটা।'' শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা--- পণ্ডিতমহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাত্ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তাহার পর দাশুর দিকে কট্মট্ করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, ``চোপ্রও, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম?'' দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, ``তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?'' পণ্ডিতমহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, ``বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? আর তুমি কি কচ্ছিলে?'' দাশু অম্লানবদনে বলিল, ``আমি তো পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।'' শুনিয়াই তো সকলের চক্ষুস্থির! ছোকরা বলে কি?
প্রায় আধমিনিটখানেক কাহারো মুখে আর কথা নাই! তার পর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গম্ভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, ``কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?'' দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, ``ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?'' এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, ``আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।'' দাশু তত্ক্ষণাত্ বলিয়া উঠিল, ``তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।'' এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না! কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে `পাগলা' বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।
ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়াও তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, ``আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্! ওর মার খাওয়াই উচিত।''
Tuesday, 30 November 2010
Monday, 29 November 2010
হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি
প্রফেসর হুঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানাকথা ছাপিয়েছি; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভুত শিকার কাহিনীর কোনো উল্লেখ করি নি। সত্যি এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সে-সব কাহিনী কিছুই জানতাম না। কিন্তু প্রফেসর হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এ-সব কথা সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিয়ো।
২৬শে জুন ১৯২২--- কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবসুদ্ধ দশজন--- আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুইজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।
নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সব কুলিদের জিম্মায় দিয়ে, আমি, চন্দ্রখাই আর শিকারী দুজনকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বন্দুক, ম্যাপ আর একটা মস্ত বাক্স, তাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর খাবার জিনিস। দুঘণ্টা পথ চলে আমরা এক জায়গায় এলাম, সেখানকার সবই কেমন অদ্ভুতরকম। বড়ো-বড়ো গাছ, তার একটারও নাম আমরা জানি না। একটা গাছে প্রকাণ্ড বেলের মতো মস্ত-মস্ত লাল রঙের ফল ঝুলছে; একটা ফুলের গাছ দেখলাম, তাতে হলদে সাদা ফুল হয়েছে, এক-একটা দেড় হাত লম্বা। আর-একটা গাছে ঝিঙের মতো কি সব ঝুলছে, পঁচিশ হাত দূর থেকে তার ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় হঠাত্ হুপ্হাপ্ গুব্গাপ্ শব্দে পাহাড়ের উপর থেকে ভয়ানক একটা কোলাহল শোনা গেল।
আমি আর শিকারী দুজন তত্ক্ষণাত্ বন্দুক নিয়ে খাড়া; কিন্তু চন্দ্রখাই বাক্স থেকে দুই টিন জ্যাম বের করে নিশ্চিন্তে বসে খেতে লাগল। ঐটে তার একটা মস্ত দোষ; খাওয়া পেলে আর তার বিপদ আপদ কিছু জ্ঞান থাকে না। এইভাবে প্রায় মিনিট দুই দাঁড়িয়ে থাকবার পর লক্কড় সিং হঠাত্ দেখতে পেল হাতির চাইতেও বড়ো একটা জন্তু গাছের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। প্রথমে দেখে মনে হল একটা প্রকাণ্ড মানুষ, তার পর মনে হল মানুষ নয় বাঁদর, তার পর দেখি মানুষও নয়, বাঁদরও নয়--- একেবারে নতুন রকমের জন্তু। সে লাল লাল ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে আর আমাদের দিকে ফিরে ফিরে ঠিক মানুষের মতো করে হাসছে। দেখতে দেখতে পঁচিশ-ত্রিশটা ফল সে টপাটপ্ খেয়ে শেষ করল। আমরা এই সুযোগে তার কয়েকখানা ছবি তুলে ফেললাম। তার পর চন্দ্রখাই ভরসা করে এগিয়ে গিয়ে তাকে কিছু খাবার দিয়ে আসল। জন্তুটা মহা খুশি হয়ে এক গ্রাসে আস্ত একখানা পাঁউরুটি আর প্রায় আধসের গুড় শেষ করে, তার পর পাঁচ-সাতটা সিদ্ধ ডিম খোলাসুদ্ধ কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। একটা টিনে করে গুড় দেওয়া হয়েছিল, সেই টিনটাও সে খাবার মতলব করেছিল, কিন্তু খানিকক্ষণ চিবিয়ে হঠাত্ বিশ্রী মুখ করে সে কান্নার সুরে গাঁও গাঁও শব্দে বিকট চীত্কার করে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি জন্তুটার নাম দিয়েছি হ্যাংলাথেরিয়াম্।
২৪শে জুলাই, ১৯২২--- বন্দাকুশ পাহাড়ের একুশ মাইল উত্তর। এখানে এত দেখবার জিনিস আছে, নতুন নতুন এত-সব গাছপালা জীবজন্তু, যে তারই সন্ধান করতে আর নমুনা সংগ্রহ করতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছে। দুশোরকম পোকা আর প্রজাপতি আর পাঁচশো রকম গাছপালা ফুলফল সংগ্রহ করেছি; আর ছবি যে কত তুলেছি তার সংখ্যাই হয় না। একটা কোনো জ্যান্ত জানোয়ার ধরে সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা, দেখা যাক কতদূর কি হয়। সেবার যখন কট্ক টোডন্ আমায় তাড়া করেছিল, তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। এবার তাই জলজ্যান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
আমরা যখন বন্দাকুশ পাহাড়ে উঠেছিলাম, তখন পাহাড়টা কত উঁচু তা মাপা হয়নি। সেদিন জরীপের যন্ত্র দিয়ে আমি আর চন্দ্রখাই পাহাড়টাকে মেপে দেখলাম। আমার হিসেব হল ষোলোহাজার ফুট। কিন্তু চন্দ্রখাই হিসাব করল বেয়াল্লিশহাজার। তাই আজ আবার সাবধানে দুজনে মিলে মেপে দেখলাম, এবার হল মোটে দুহাজার সাতশো ফুট। বোধ হয় আমাদের যন্ত্রে কোনো দোষ হয়ে থাকবে! যাহোক এটা নিশ্চয় যে এপর্যন্ত ঐ পাহাড়ের চুড়োয় আর কেউ ওঠে নি। এ-এক সম্পূর্ণ অজানা দেশ, কোথাও জন মানুষের চিহ্নমাত্র নাই, নিজেদের ম্যাপ নিজেরা তৈরি করে পথ চলতে হয়।
আজ সকালে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। লক্কড় সিং একটা গাছে হলদে রঙের ফল ফলেছে দেখে তারই একটুখানি খেতে গিয়েছিল। এক কামড় খেতেই হঠাত্ হাত-পা খিঁচিয়ে সে আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে ছট্ফট্ করতে লাগল। তাই দেখে ছক্কড় সিং ``ভাইয়া রে, ভাইয়া'' বলে কেঁদে অস্থির। যাহোক মিনিট দশেক ঐরকম হাত-পা ছুঁড়ে লক্কড় সিং একটু ঠাণ্ডা হয়ে উঠে বসল। তখন আমাদের চোখে পড়ল যে একটা জন্তু কাছেই ঝোপের আড়াল থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মতন মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখলে মনে হয় যে, সংসারে তার কোনো সুখ নেই, এ-সব গোলমাল কান্নাকাটি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আমি তার নাম দিয়েছি গোমড়াথেরিয়াম্। এমন খিট্খিটে খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজের জন্তু আর আমরা দ্বিতীয় দেখি নি। আমরা তাকে তোয়াজ টোয়াজ করে খাবার দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম। সে অত্যন্ত বিশ্রী মতো মুখ করে, ফোঁস্ ফোঁস্ ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে অনেক আপত্তি জানিয়ে, আধখানা পাঁউরুটি আর দুটো কলা খেয়ে তার পর একটুখানি পেয়ারার জেলি মুখে দিতেই এমন চটে গেল যে রেগে সারা গায়ে জেলি আর মাখন মাখিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
১৪ই আগস্ট, বন্দাকুশ পাহাড়ের পঁচিশ মাইল উত্তর--- ট্যাপ্ ট্যাপ্ থ্যাপ্ থ্যাপ্ ঝুপ্ ঝাপ্--- সকালবেলায় খেতে বসেছি, এমন সময় এইরকম একটা শব্দ শোনা গেল। একটুখানি উঁকি মেরে দেখি আমাদের তাঁবুর কাছে প্রায় উটপাখির মতন বড়ো একটা অদ্ভুতরকম পাখি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোন দিকে চলবে তার কিছুই যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। ডান পা এদিকে যায় তো বাঁ পা ওদিকে; সামনে চলবে তো পিছনভাগে চায়, দশ পা না যেতেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে। তার বোধ হয় ইচ্ছা ছিল তাঁবুটা ভালো করে দেখে, কিন্তু হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়ে সে এমন ভড়কে গেল যে তক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে হুড়্মুড়্ করে পড়ে গেল। তার পর এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে প্রায় হাত দশেক গিয়ে আবার হেলেদুলে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চন্দ্রখাই বলল, ``ঠিক হয়েছে, এইটাকে ধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক।'' তখন সকলের উত্সাহ দেখে কে! আমি ছক্কড় সিংকে বললাম, ``তুমি বন্দুকের আওয়াজ কর, তা হলে পাখিটা নিশ্চয়ই চমকে পড়ে যাবে আর সেই সুযোগে আমরা চার-পাঁচজন তাকে চেপে ধরব! ছক্কড় সিং বন্দুক নিয়ে আওয়াজ করতেই পাখিটা ঠ্যাং মুড়ে মাটির উপর বসে পড়ল, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে ক্যাট্ ক্যাট্ শব্দ করে ভয়ানক জোরে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল। তাই দেখে আমাদের আর এগুতে সাহস হল না। কিন্তু লক্কড় সিং হাজার হোক তেজী লোক, সে দৌড়ে গিয়ে পাখিটার বুকে ধাঁই করে এক ছাতার বাড়ি বসিয়ে দিল। ছাতার বাড়ি খেয়ে পাখিটা তত্ক্ষণাত্ দুই পা ফাঁক করে উঠে দাঁড়াল। তার পর লক্কড় সিং-এর দাড়িতে কামড়ে ধরে তার ঘাড়ের উপর দুই পা দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের বিপদ দেখে ছক্কড় সিং বন্দুকের বাঁট দিয়ে পাখিটার মাথাটা থেঁত্লে দেবার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সে আঘাতটা পাখিটার মাথায় লাগল না, লাগল গিয়ে লক্কড় সিং-এর বুকে। তাতে পাখিটা ভয় পেয়ে লক্কড় সিংকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু দুই ভাইয়ে এমন মারামারি বেঁধে উঠল যে আমরা ভাবলাম দুটোই এবার মরে বুঝি। দুজনের তেজ কি তখন! আমি আর দুজন কুলি লক্কড় সিং-এর জামা ধরে টেনে রাখছি, সে আমাদের সুদ্ধ হিঁচড়ে নিয়ে ভাইয়ের নাকে ঘুষি চালাচ্ছে। চন্দ্রখাই রীতিমতো ভারিক্কে মানুষ; সে ছক্কড় সিং-এর কোমর ধরে লটকে আছে, ছক্কড় সিং তাইসুদ্ধ মাটি থেকে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বন্বন্ করে বন্দুক ঘোরাচ্ছে। হাজার হোক পাঞ্জাবের লোক কি না। মারামারি থামাতে গিয়ে সেই ফাঁকে পাখিটা যে কখন পালালো তা আমরা টেরই পেলাম না। যা হোক এই ল্যাগ্ব্যাগ পাখি বা ল্যাগ-ব্যাগর্নিসের কতকগুলো পালক আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ হয়েছিল। তাতেই যথেষ্ট প্রমাণ হবে।
১লা সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- আমাদের সঙ্গের খাবার ইত্যাদি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তরিতরকারি যা ছিল, তা তো আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিসের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে, তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়, তা ছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ, আর মাংস। এই-সব কয়েক সপ্তাহের মতো আছে, সুতরাং এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ফিরতে হবে। আমরা এই সব জিনিস গুনছি আর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি, এমন সময় ছক্কড় সিং বলল, যে লক্কড় সিং ভোরবেলা কোথায় বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত ফেরে নি। আমরা বললাম, ``ব্যস্ত কেন, সে আসবে এখন। যাবে আবার কোথায়? কিন্তু তার পরেও দুই-তিন ঘণ্টা গেল অথচ লক্কড় সিং-এর দেখা পাওয়া গেল না। আমরা তাকে খুঁজতে বেরুবার পরামর্শ করছি, এমন সময় হঠাত্ একটা ঝোপের উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড জানোয়ারের মাথা দেখা গেল। মাথাটা উঠছে নামছে আর মাতালের মতো টলছে। দেখেই আমরা সুড়্সুড়্ করে তাঁবুর আড়ালে পালাতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম লক্কড় সিং চেঁচিয়ে বলছে, ``পালিয়ো না, পালিয়ো না, ও কিছু বলবে না।'' তার পরের মুহূর্তেই দেখি লক্কড় সিং বুক ফুলিয়ে সেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার পাগড়ীর কাপড় দিয়ে সে ঐ অত বড়ো জানোয়ারটাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে লক্কড় সিং বলল, যে সে সকালবেলায় কুঁজো নিয়ে নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিল। ফিরবার সময় এই জন্তুটার সাথে তার দেখা। তাকে দেখেই জন্তুটা মাটিতে শুয়ে কোঁ-কোঁ শব্দ করতে লাগল। সে দেখল জন্তুটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে আর তাই দিয়ে দর্দর্ করে রক্ত পড়ছে। লক্কড় সিং খুব সাহস করে তার পায়ের কাঁটাটি তুলে, বেশ করে মুছে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। তার পর জানোয়ারটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে দেখে সে তাকে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই বললাম, ``তা হলে এটা ঐরকম বাঁধাই থাক, দেখি ওটাকে সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।'' জন্তুটার নাম রাখা গেল ল্যাংড়াথেরিয়াম্।
সকালে তো এই কাণ্ড হল; বিকালবেলা আর এক ফ্যাসাদ উপস্থিত। তখন আমরা সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরেছি। হঠাত্ আমাদের তাঁবুর বেশ কাছেই একটা বিকট চীত্কারের শব্দ শোনা গেল। অনেকগুলো চিল আর পেঁচা একসঙ্গে চেঁচালে যেরকম আওয়াজ হয়, কতকটা সেইরকম। ল্যাংড়াথেরিয়ামটা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে একটা গাছের লম্বা-লম্বা পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল; চীত্কার শুনবামাত্র সে, ঠিক শেয়াল যেমন করে ফেউ ডাকে সেইরকম ধরনের একটা বিকট শব্দ করে, বাঁধন-টাঁধন ছিঁড়ে, কতক লাফিয়ে কতক দৌড়িয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে, ভয়ে ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড জন্তু--- সেটা কুমিরও নয়, সাপও নয়, মাছও নয়, অথচ তিনটারই কিছু আদল আছে--- সে এক হাত মস্ত হাঁ করে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে; আর একটা ছোটো নিরীহ গোছের কি যেন জানোয়ার হাত-পা এলিয়ে ঠিক তার মুখের সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আমরা মনে করলাম, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেবল চীত্কারই চলতে লাগল; খাবার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না। লক্কড় সিং বলল, ``আমি ওটাকে গুলি করি।'' আমি বললাম, ``কাজ নেই, গুলি যদি ঠিকমতো না লাগে, তা হলে জন্তুটা ক্ষেপে গিয়ে কি জানি করে বসবে, তা কে জানে?'' এই বলতে বলতেই ধেড়ে জন্তুটা চীত্কার থামিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নদীর দিকে চলে গেল। চন্দ্রখাই বলল, ``এ জন্তুটার নাম দেওয়া যাক চিল্লানোসরাস্।'' ছক্কড় সিং বলল, ``উ বাচ্চাকো নাম দেও, বেচারাথেরিয়াম্।''
৭ই সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- নদীর বাঁক ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের একেবারে শেষ কিনারায় এসে পড়েছি। আর কোনোদিকে এগোবার জো নাই। দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়, সোজা দুশো তিনশো হাত নীচে সমতল জমি পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই এরকম। নীচের যে সমতল জমি সে একেবারে মরুভূমির মতো; কোথাও গাছপালা, জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নাই। আমরা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় ঝুঁকে পড়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় আমাদের ঠিক হাত পঞ্চাশেক নীচেই কি যেন ধড়্ফড়্ করে উঠল। দেখলাম বেশ একটা মাঝারি গোছের তিমি মাছের মতো মস্ত কি একটা জন্তু পাহাড়ের গায়ে আঁকড়ে ধরে বাদুড়ের মতো মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে এইরকম আরো পাঁচ-সাতটা জন্তু দেখতে পেলাম। কোনোটা ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে, কোনোটা লম্বা গলা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে, আর অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে বের করে খাচ্ছে। এইরকম দেখছি এমন সময় হঠাত্ কট্ কটাং কট্ শব্দ করে সেই প্রথম জন্তুটা হুড়ুত্ করে ডানা মেলে একেবারে সোজা আমাদের দিকে উড়ে আসতে লাগল। ভয়ে আমাদের হাত-পাগুলো গুটিয়ে আসতে লাগল; এমন বিপদের সময়ে যে পালানো দরকার, তা পর্যন্ত আমরা ভুলে গেলাম। জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে আমাদের মাথার উপরে এসে পড়ল। তার পর যে কি হল তা আমার ভালো করে মনে নাই--- খালি একটু একটু মনে পড়ে, একটা অসম্ভব বিটকেল গন্ধের সঙ্গে ঝড়ের মতো ডানা ঝাপটানো আর জন্তুটার ভয়ানক কট্ কটাং আওয়াজ। একটুখানি ডানার ঝাপটা আমার গায়ে লেগেছিল তাতেই আমার দম বেরিয়ে প্রাণ বের হবার যোগাড় করেছিল। অন্যসকলের অবস্থাও সেইরকম অথবা তার চাইতেও খারাপ। যখন আমার হুঁশ হল তখন দেখি সকলেরই গা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ছক্কড় সিং-এর একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে, লক্কড় সিং-এর বাঁ হাতটা এমন মচকে গিয়েছে যে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আমারও সমস্ত বুকে পিঠে বেদনা ধরে গিয়েছে; কেবল চন্দ্রখাই এক হাতে রুমাল দিয়ে কপালের আর ঘাড়ের রক্ত মুছছে, আর-এক হাতে একমুঠো বিস্কুট নিয়ে খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। আমরা তখনই আর বেশি আলোচনা না করে জিনিসপত্র গুটিয়ে বন্দাকুশ পাহাড়ের দিকে ফিরে চললাম।
[ প্রফেসর হুঁশিয়ারের ডায়েরি এইখানেই শেষ। কিন্তু আমরা আরো খবর জানবার জন্য তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে তিনি তাঁর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন, ``এর কাছেই সব খবর পাবে।'' চন্দ্রখাই-এর সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয় খুব সংক্ষেপে তা হচ্ছে এই---
আমরা। আপনারা যে-সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সে-সব কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়?
চন্দ্র। সে-সব হারিয়ে গেছে।
আমরা। বলেন কি! হারিয়ে গেল? এমন সব জিনিস হারিয়ে ফেললেন!
চন্দ্র। হ্যাঁ, প্রাণটুকু যে হারায় নি তাই যথেষ্ট। সে-দেশের ঝড় তো আপনারা দেখেন নি। তার এক-এক ঝাপটায় আমাদের যন্ত্রপাতি, বড়ো-বড়ো তাঁবু আর নমুনার বাক্স, সব কাগজের মতো হুস্ করে উড়িয়ে নেয়। আমাকেই তো পাঁচ-সাতবার উড়িয়ে নিয়েছিল। একবার তো ভাবলাম মরেই গেছি। কুকুরটাকে যে কোথায় উড়িয়ে নিল, সে তো আর খুঁজেই পেলাম না। সে যা বিপদ! কাঁটা কম্পাস, প্ল্যান ম্যাপ, খাতাপত্র কিছুই আর বাকি রাখে নি। কি করে যে ফিরলাম, তা শুনলে আপনার ঐ চুল দাড়ি সব সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠবে। আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে, আন্দাজে পথ চলে, দুই সপ্তাহের রাস্তা পার হতে আমাদের পুরো তিনমাস লেগেছিল।
আমরা। তা হলে আপনাদের প্রমাণ-টমান যা কিছু ছিল সব নষ্ট হয়েছে?
চন্দ্র। এই তো আমি রয়েছি, মামা রয়েছেন, আবার কি প্রমাণ চাই, আর এই আপনাদের জন্য কতকগুলো ছবি এঁকে এনেছি; এতেও অনেকটা প্রমাণ হবে।
আমাদের ছাপাখানার একটা ছোকরা ঠাট্টা করে বলল, ``আপনি কোন থেরিয়াম?'' আর-একজন বলল, ``উনি হচ্ছেন গপ্পথেরিয়াম--- বসে বসে গপ্প মারছেন।'' শুনে চন্দ্রখাই ভীষণ রেগে আমাদের টেবিল থেকে একমুঠো চীনেবাদাম আর গোটা আষ্টেক পান উঠিয়ে নিয়ে গজ্গজ্ করতে করতে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার তো এই। এখন তোমরা কেউ যদি আরো জানতে চাও, তা হলে আমাদের ঠিকানায় প্রফেসর হুঁশিয়ারকে চিঠি লিখলে আমরা তার জবাব আনিয়ে দিতে পারি। ]
২৬শে জুন ১৯২২--- কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবসুদ্ধ দশজন--- আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুইজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।
নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সব কুলিদের জিম্মায় দিয়ে, আমি, চন্দ্রখাই আর শিকারী দুজনকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বন্দুক, ম্যাপ আর একটা মস্ত বাক্স, তাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর খাবার জিনিস। দুঘণ্টা পথ চলে আমরা এক জায়গায় এলাম, সেখানকার সবই কেমন অদ্ভুতরকম। বড়ো-বড়ো গাছ, তার একটারও নাম আমরা জানি না। একটা গাছে প্রকাণ্ড বেলের মতো মস্ত-মস্ত লাল রঙের ফল ঝুলছে; একটা ফুলের গাছ দেখলাম, তাতে হলদে সাদা ফুল হয়েছে, এক-একটা দেড় হাত লম্বা। আর-একটা গাছে ঝিঙের মতো কি সব ঝুলছে, পঁচিশ হাত দূর থেকে তার ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় হঠাত্ হুপ্হাপ্ গুব্গাপ্ শব্দে পাহাড়ের উপর থেকে ভয়ানক একটা কোলাহল শোনা গেল।
আমি আর শিকারী দুজন তত্ক্ষণাত্ বন্দুক নিয়ে খাড়া; কিন্তু চন্দ্রখাই বাক্স থেকে দুই টিন জ্যাম বের করে নিশ্চিন্তে বসে খেতে লাগল। ঐটে তার একটা মস্ত দোষ; খাওয়া পেলে আর তার বিপদ আপদ কিছু জ্ঞান থাকে না। এইভাবে প্রায় মিনিট দুই দাঁড়িয়ে থাকবার পর লক্কড় সিং হঠাত্ দেখতে পেল হাতির চাইতেও বড়ো একটা জন্তু গাছের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। প্রথমে দেখে মনে হল একটা প্রকাণ্ড মানুষ, তার পর মনে হল মানুষ নয় বাঁদর, তার পর দেখি মানুষও নয়, বাঁদরও নয়--- একেবারে নতুন রকমের জন্তু। সে লাল লাল ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে আর আমাদের দিকে ফিরে ফিরে ঠিক মানুষের মতো করে হাসছে। দেখতে দেখতে পঁচিশ-ত্রিশটা ফল সে টপাটপ্ খেয়ে শেষ করল। আমরা এই সুযোগে তার কয়েকখানা ছবি তুলে ফেললাম। তার পর চন্দ্রখাই ভরসা করে এগিয়ে গিয়ে তাকে কিছু খাবার দিয়ে আসল। জন্তুটা মহা খুশি হয়ে এক গ্রাসে আস্ত একখানা পাঁউরুটি আর প্রায় আধসের গুড় শেষ করে, তার পর পাঁচ-সাতটা সিদ্ধ ডিম খোলাসুদ্ধ কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। একটা টিনে করে গুড় দেওয়া হয়েছিল, সেই টিনটাও সে খাবার মতলব করেছিল, কিন্তু খানিকক্ষণ চিবিয়ে হঠাত্ বিশ্রী মুখ করে সে কান্নার সুরে গাঁও গাঁও শব্দে বিকট চীত্কার করে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি জন্তুটার নাম দিয়েছি হ্যাংলাথেরিয়াম্।
২৪শে জুলাই, ১৯২২--- বন্দাকুশ পাহাড়ের একুশ মাইল উত্তর। এখানে এত দেখবার জিনিস আছে, নতুন নতুন এত-সব গাছপালা জীবজন্তু, যে তারই সন্ধান করতে আর নমুনা সংগ্রহ করতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছে। দুশোরকম পোকা আর প্রজাপতি আর পাঁচশো রকম গাছপালা ফুলফল সংগ্রহ করেছি; আর ছবি যে কত তুলেছি তার সংখ্যাই হয় না। একটা কোনো জ্যান্ত জানোয়ার ধরে সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা, দেখা যাক কতদূর কি হয়। সেবার যখন কট্ক টোডন্ আমায় তাড়া করেছিল, তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। এবার তাই জলজ্যান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
আমরা যখন বন্দাকুশ পাহাড়ে উঠেছিলাম, তখন পাহাড়টা কত উঁচু তা মাপা হয়নি। সেদিন জরীপের যন্ত্র দিয়ে আমি আর চন্দ্রখাই পাহাড়টাকে মেপে দেখলাম। আমার হিসেব হল ষোলোহাজার ফুট। কিন্তু চন্দ্রখাই হিসাব করল বেয়াল্লিশহাজার। তাই আজ আবার সাবধানে দুজনে মিলে মেপে দেখলাম, এবার হল মোটে দুহাজার সাতশো ফুট। বোধ হয় আমাদের যন্ত্রে কোনো দোষ হয়ে থাকবে! যাহোক এটা নিশ্চয় যে এপর্যন্ত ঐ পাহাড়ের চুড়োয় আর কেউ ওঠে নি। এ-এক সম্পূর্ণ অজানা দেশ, কোথাও জন মানুষের চিহ্নমাত্র নাই, নিজেদের ম্যাপ নিজেরা তৈরি করে পথ চলতে হয়।
আজ সকালে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। লক্কড় সিং একটা গাছে হলদে রঙের ফল ফলেছে দেখে তারই একটুখানি খেতে গিয়েছিল। এক কামড় খেতেই হঠাত্ হাত-পা খিঁচিয়ে সে আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে ছট্ফট্ করতে লাগল। তাই দেখে ছক্কড় সিং ``ভাইয়া রে, ভাইয়া'' বলে কেঁদে অস্থির। যাহোক মিনিট দশেক ঐরকম হাত-পা ছুঁড়ে লক্কড় সিং একটু ঠাণ্ডা হয়ে উঠে বসল। তখন আমাদের চোখে পড়ল যে একটা জন্তু কাছেই ঝোপের আড়াল থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মতন মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখলে মনে হয় যে, সংসারে তার কোনো সুখ নেই, এ-সব গোলমাল কান্নাকাটি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আমি তার নাম দিয়েছি গোমড়াথেরিয়াম্। এমন খিট্খিটে খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজের জন্তু আর আমরা দ্বিতীয় দেখি নি। আমরা তাকে তোয়াজ টোয়াজ করে খাবার দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম। সে অত্যন্ত বিশ্রী মতো মুখ করে, ফোঁস্ ফোঁস্ ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে অনেক আপত্তি জানিয়ে, আধখানা পাঁউরুটি আর দুটো কলা খেয়ে তার পর একটুখানি পেয়ারার জেলি মুখে দিতেই এমন চটে গেল যে রেগে সারা গায়ে জেলি আর মাখন মাখিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
১৪ই আগস্ট, বন্দাকুশ পাহাড়ের পঁচিশ মাইল উত্তর--- ট্যাপ্ ট্যাপ্ থ্যাপ্ থ্যাপ্ ঝুপ্ ঝাপ্--- সকালবেলায় খেতে বসেছি, এমন সময় এইরকম একটা শব্দ শোনা গেল। একটুখানি উঁকি মেরে দেখি আমাদের তাঁবুর কাছে প্রায় উটপাখির মতন বড়ো একটা অদ্ভুতরকম পাখি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোন দিকে চলবে তার কিছুই যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। ডান পা এদিকে যায় তো বাঁ পা ওদিকে; সামনে চলবে তো পিছনভাগে চায়, দশ পা না যেতেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে। তার বোধ হয় ইচ্ছা ছিল তাঁবুটা ভালো করে দেখে, কিন্তু হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়ে সে এমন ভড়কে গেল যে তক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে হুড়্মুড়্ করে পড়ে গেল। তার পর এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে প্রায় হাত দশেক গিয়ে আবার হেলেদুলে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চন্দ্রখাই বলল, ``ঠিক হয়েছে, এইটাকে ধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক।'' তখন সকলের উত্সাহ দেখে কে! আমি ছক্কড় সিংকে বললাম, ``তুমি বন্দুকের আওয়াজ কর, তা হলে পাখিটা নিশ্চয়ই চমকে পড়ে যাবে আর সেই সুযোগে আমরা চার-পাঁচজন তাকে চেপে ধরব! ছক্কড় সিং বন্দুক নিয়ে আওয়াজ করতেই পাখিটা ঠ্যাং মুড়ে মাটির উপর বসে পড়ল, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে ক্যাট্ ক্যাট্ শব্দ করে ভয়ানক জোরে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল। তাই দেখে আমাদের আর এগুতে সাহস হল না। কিন্তু লক্কড় সিং হাজার হোক তেজী লোক, সে দৌড়ে গিয়ে পাখিটার বুকে ধাঁই করে এক ছাতার বাড়ি বসিয়ে দিল। ছাতার বাড়ি খেয়ে পাখিটা তত্ক্ষণাত্ দুই পা ফাঁক করে উঠে দাঁড়াল। তার পর লক্কড় সিং-এর দাড়িতে কামড়ে ধরে তার ঘাড়ের উপর দুই পা দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের বিপদ দেখে ছক্কড় সিং বন্দুকের বাঁট দিয়ে পাখিটার মাথাটা থেঁত্লে দেবার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সে আঘাতটা পাখিটার মাথায় লাগল না, লাগল গিয়ে লক্কড় সিং-এর বুকে। তাতে পাখিটা ভয় পেয়ে লক্কড় সিংকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু দুই ভাইয়ে এমন মারামারি বেঁধে উঠল যে আমরা ভাবলাম দুটোই এবার মরে বুঝি। দুজনের তেজ কি তখন! আমি আর দুজন কুলি লক্কড় সিং-এর জামা ধরে টেনে রাখছি, সে আমাদের সুদ্ধ হিঁচড়ে নিয়ে ভাইয়ের নাকে ঘুষি চালাচ্ছে। চন্দ্রখাই রীতিমতো ভারিক্কে মানুষ; সে ছক্কড় সিং-এর কোমর ধরে লটকে আছে, ছক্কড় সিং তাইসুদ্ধ মাটি থেকে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বন্বন্ করে বন্দুক ঘোরাচ্ছে। হাজার হোক পাঞ্জাবের লোক কি না। মারামারি থামাতে গিয়ে সেই ফাঁকে পাখিটা যে কখন পালালো তা আমরা টেরই পেলাম না। যা হোক এই ল্যাগ্ব্যাগ পাখি বা ল্যাগ-ব্যাগর্নিসের কতকগুলো পালক আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ হয়েছিল। তাতেই যথেষ্ট প্রমাণ হবে।
১লা সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- আমাদের সঙ্গের খাবার ইত্যাদি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তরিতরকারি যা ছিল, তা তো আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিসের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে, তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়, তা ছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ, আর মাংস। এই-সব কয়েক সপ্তাহের মতো আছে, সুতরাং এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ফিরতে হবে। আমরা এই সব জিনিস গুনছি আর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি, এমন সময় ছক্কড় সিং বলল, যে লক্কড় সিং ভোরবেলা কোথায় বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত ফেরে নি। আমরা বললাম, ``ব্যস্ত কেন, সে আসবে এখন। যাবে আবার কোথায়? কিন্তু তার পরেও দুই-তিন ঘণ্টা গেল অথচ লক্কড় সিং-এর দেখা পাওয়া গেল না। আমরা তাকে খুঁজতে বেরুবার পরামর্শ করছি, এমন সময় হঠাত্ একটা ঝোপের উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড জানোয়ারের মাথা দেখা গেল। মাথাটা উঠছে নামছে আর মাতালের মতো টলছে। দেখেই আমরা সুড়্সুড়্ করে তাঁবুর আড়ালে পালাতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম লক্কড় সিং চেঁচিয়ে বলছে, ``পালিয়ো না, পালিয়ো না, ও কিছু বলবে না।'' তার পরের মুহূর্তেই দেখি লক্কড় সিং বুক ফুলিয়ে সেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার পাগড়ীর কাপড় দিয়ে সে ঐ অত বড়ো জানোয়ারটাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে লক্কড় সিং বলল, যে সে সকালবেলায় কুঁজো নিয়ে নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিল। ফিরবার সময় এই জন্তুটার সাথে তার দেখা। তাকে দেখেই জন্তুটা মাটিতে শুয়ে কোঁ-কোঁ শব্দ করতে লাগল। সে দেখল জন্তুটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে আর তাই দিয়ে দর্দর্ করে রক্ত পড়ছে। লক্কড় সিং খুব সাহস করে তার পায়ের কাঁটাটি তুলে, বেশ করে মুছে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। তার পর জানোয়ারটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে দেখে সে তাকে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই বললাম, ``তা হলে এটা ঐরকম বাঁধাই থাক, দেখি ওটাকে সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।'' জন্তুটার নাম রাখা গেল ল্যাংড়াথেরিয়াম্।
সকালে তো এই কাণ্ড হল; বিকালবেলা আর এক ফ্যাসাদ উপস্থিত। তখন আমরা সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরেছি। হঠাত্ আমাদের তাঁবুর বেশ কাছেই একটা বিকট চীত্কারের শব্দ শোনা গেল। অনেকগুলো চিল আর পেঁচা একসঙ্গে চেঁচালে যেরকম আওয়াজ হয়, কতকটা সেইরকম। ল্যাংড়াথেরিয়ামটা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে একটা গাছের লম্বা-লম্বা পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল; চীত্কার শুনবামাত্র সে, ঠিক শেয়াল যেমন করে ফেউ ডাকে সেইরকম ধরনের একটা বিকট শব্দ করে, বাঁধন-টাঁধন ছিঁড়ে, কতক লাফিয়ে কতক দৌড়িয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে, ভয়ে ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড জন্তু--- সেটা কুমিরও নয়, সাপও নয়, মাছও নয়, অথচ তিনটারই কিছু আদল আছে--- সে এক হাত মস্ত হাঁ করে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে; আর একটা ছোটো নিরীহ গোছের কি যেন জানোয়ার হাত-পা এলিয়ে ঠিক তার মুখের সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আমরা মনে করলাম, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেবল চীত্কারই চলতে লাগল; খাবার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না। লক্কড় সিং বলল, ``আমি ওটাকে গুলি করি।'' আমি বললাম, ``কাজ নেই, গুলি যদি ঠিকমতো না লাগে, তা হলে জন্তুটা ক্ষেপে গিয়ে কি জানি করে বসবে, তা কে জানে?'' এই বলতে বলতেই ধেড়ে জন্তুটা চীত্কার থামিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নদীর দিকে চলে গেল। চন্দ্রখাই বলল, ``এ জন্তুটার নাম দেওয়া যাক চিল্লানোসরাস্।'' ছক্কড় সিং বলল, ``উ বাচ্চাকো নাম দেও, বেচারাথেরিয়াম্।''
৭ই সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- নদীর বাঁক ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের একেবারে শেষ কিনারায় এসে পড়েছি। আর কোনোদিকে এগোবার জো নাই। দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়, সোজা দুশো তিনশো হাত নীচে সমতল জমি পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই এরকম। নীচের যে সমতল জমি সে একেবারে মরুভূমির মতো; কোথাও গাছপালা, জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নাই। আমরা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় ঝুঁকে পড়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় আমাদের ঠিক হাত পঞ্চাশেক নীচেই কি যেন ধড়্ফড়্ করে উঠল। দেখলাম বেশ একটা মাঝারি গোছের তিমি মাছের মতো মস্ত কি একটা জন্তু পাহাড়ের গায়ে আঁকড়ে ধরে বাদুড়ের মতো মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে এইরকম আরো পাঁচ-সাতটা জন্তু দেখতে পেলাম। কোনোটা ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে, কোনোটা লম্বা গলা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে, আর অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে বের করে খাচ্ছে। এইরকম দেখছি এমন সময় হঠাত্ কট্ কটাং কট্ শব্দ করে সেই প্রথম জন্তুটা হুড়ুত্ করে ডানা মেলে একেবারে সোজা আমাদের দিকে উড়ে আসতে লাগল। ভয়ে আমাদের হাত-পাগুলো গুটিয়ে আসতে লাগল; এমন বিপদের সময়ে যে পালানো দরকার, তা পর্যন্ত আমরা ভুলে গেলাম। জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে আমাদের মাথার উপরে এসে পড়ল। তার পর যে কি হল তা আমার ভালো করে মনে নাই--- খালি একটু একটু মনে পড়ে, একটা অসম্ভব বিটকেল গন্ধের সঙ্গে ঝড়ের মতো ডানা ঝাপটানো আর জন্তুটার ভয়ানক কট্ কটাং আওয়াজ। একটুখানি ডানার ঝাপটা আমার গায়ে লেগেছিল তাতেই আমার দম বেরিয়ে প্রাণ বের হবার যোগাড় করেছিল। অন্যসকলের অবস্থাও সেইরকম অথবা তার চাইতেও খারাপ। যখন আমার হুঁশ হল তখন দেখি সকলেরই গা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ছক্কড় সিং-এর একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে, লক্কড় সিং-এর বাঁ হাতটা এমন মচকে গিয়েছে যে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আমারও সমস্ত বুকে পিঠে বেদনা ধরে গিয়েছে; কেবল চন্দ্রখাই এক হাতে রুমাল দিয়ে কপালের আর ঘাড়ের রক্ত মুছছে, আর-এক হাতে একমুঠো বিস্কুট নিয়ে খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। আমরা তখনই আর বেশি আলোচনা না করে জিনিসপত্র গুটিয়ে বন্দাকুশ পাহাড়ের দিকে ফিরে চললাম।
[ প্রফেসর হুঁশিয়ারের ডায়েরি এইখানেই শেষ। কিন্তু আমরা আরো খবর জানবার জন্য তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে তিনি তাঁর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন, ``এর কাছেই সব খবর পাবে।'' চন্দ্রখাই-এর সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয় খুব সংক্ষেপে তা হচ্ছে এই---
আমরা। আপনারা যে-সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সে-সব কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়?
চন্দ্র। সে-সব হারিয়ে গেছে।
আমরা। বলেন কি! হারিয়ে গেল? এমন সব জিনিস হারিয়ে ফেললেন!
চন্দ্র। হ্যাঁ, প্রাণটুকু যে হারায় নি তাই যথেষ্ট। সে-দেশের ঝড় তো আপনারা দেখেন নি। তার এক-এক ঝাপটায় আমাদের যন্ত্রপাতি, বড়ো-বড়ো তাঁবু আর নমুনার বাক্স, সব কাগজের মতো হুস্ করে উড়িয়ে নেয়। আমাকেই তো পাঁচ-সাতবার উড়িয়ে নিয়েছিল। একবার তো ভাবলাম মরেই গেছি। কুকুরটাকে যে কোথায় উড়িয়ে নিল, সে তো আর খুঁজেই পেলাম না। সে যা বিপদ! কাঁটা কম্পাস, প্ল্যান ম্যাপ, খাতাপত্র কিছুই আর বাকি রাখে নি। কি করে যে ফিরলাম, তা শুনলে আপনার ঐ চুল দাড়ি সব সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠবে। আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে, আন্দাজে পথ চলে, দুই সপ্তাহের রাস্তা পার হতে আমাদের পুরো তিনমাস লেগেছিল।
আমরা। তা হলে আপনাদের প্রমাণ-টমান যা কিছু ছিল সব নষ্ট হয়েছে?
চন্দ্র। এই তো আমি রয়েছি, মামা রয়েছেন, আবার কি প্রমাণ চাই, আর এই আপনাদের জন্য কতকগুলো ছবি এঁকে এনেছি; এতেও অনেকটা প্রমাণ হবে।
আমাদের ছাপাখানার একটা ছোকরা ঠাট্টা করে বলল, ``আপনি কোন থেরিয়াম?'' আর-একজন বলল, ``উনি হচ্ছেন গপ্পথেরিয়াম--- বসে বসে গপ্প মারছেন।'' শুনে চন্দ্রখাই ভীষণ রেগে আমাদের টেবিল থেকে একমুঠো চীনেবাদাম আর গোটা আষ্টেক পান উঠিয়ে নিয়ে গজ্গজ্ করতে করতে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার তো এই। এখন তোমরা কেউ যদি আরো জানতে চাও, তা হলে আমাদের ঠিকানায় প্রফেসর হুঁশিয়ারকে চিঠি লিখলে আমরা তার জবাব আনিয়ে দিতে পারি। ]
পাগলা দাশু
আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহার মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে পাগলা দাশুকে চিনিয়া লয়। সেবার একজন নূতন দারোয়ান আসিল, একেবারে আনকোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই সে আন্দাজে ঠিক ধরিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ তার মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চলনে চালনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু `ছিট' আছে। তাহার চোখদুটি গোল-গোল, কানদুটা অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় এক বস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়---
ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।
সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত-পা ছোঁড়ার ভঙ্গি দেখিয়া হঠাত্ চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।
সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা-লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক-এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত, যে আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।
দাশু, অর্থাত্ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের ক্লাশের `ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশুনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি পড়া জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু পড়া বলিয়া দেওয়া দূরে থাকুক, তাহাকে বেশ দু কথা শোনাইয়া বলিল, ``আমার বুঝি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আজ এঁকে ইংরিজি বোঝাব, কাল ওঁর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আরেকজন আসবেন আরেক ফরমাইস নিয়ে--- ঐ করি আর কি!'' দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, ``তুমি তো ভারি চ্যাঁচড়া ছোটোলোক হে!'' জগবন্ধু পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে নালিশ করিল, ঐ নতুন ছেলেটা আমাকে গালাগালি দিচ্ছে।'' পণ্ডিতমহাশয় দাশুকে এমনি দু-চার ধমক দিয়া দিলেন যে, সে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।
তার পর কয়দিন দাশু জগবন্ধুর সহিত কথাবার্তা কহে নাই। পণ্ডিতমহাশয় রোজ ক্লাশে আসেন, আর যখন দরকার হয়, জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় উপক্রমণিকা চাহিলেন, জগবন্ধু তা।ড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া উপক্রমণিকাখানা বাহির করিয়া দিল। পণ্ডিতমহাশয় বইখানি খুলিয়াই হথাত্ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ``বইখানা কার?'' জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, ``আমার।'' পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, ``হুঁ---নূতন সংস্করণ বুঝি? বইকে বই একেবারে বদলে গেছে।'' এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন, ``যশোবন্ত দারোগা--- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক।'' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। পণ্ডিতমহাশয় বিকটরকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, ``স্কুলে আমার আদুরে গোপাল, আর বাড়িতে বুঝি নৃসিংহ অবতার?'' জগবন্ধু আম্তা-আম্তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, ``থাক, থাক, আর ভালোমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই---ঢের হয়েছে।'' লজ্জায়, অপমানে জগবন্ধুর দুই কান লাল হৈয়া উঠিল---আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটি দাশুভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।
দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা করিতাম। তাহাতে বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইত যেন সে বেশ আমোদ পাইতেছে। একেক সমযে সে নিজেই উত্সাহ করিয়া আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত! একদিন সে বলিল, ``ভাই, আমাদের পাড়ায় যখনই কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস?'' আমরা বলিলাম, ``খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি?'' সে বলিল, ``তা নয়। যখন আমসত্ত্ব শুকোতে দেয় আমি সেইখানে ছাদের ওপর বার দুয়েক এই চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে যত কাক সব `ত্রাহি ত্রাহি' করে ছুটে পালায়। কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।''
প্রত্যেকবার ছুটির পরে স্কুলে ফিরিবার সময় দাশু একটা-না-একটা কাণ্ড বাধাইয়া আসে। একবার সে হঠাত্ পেণ্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢলঢলে পায়জামার মতো পেণ্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ``পেণ্টেলুন পরেছিস কেন?'' দাশু একগাল হাসিয়া বলিল, ``ভালো করে ইংরাজি শিখব বলে।'' আরেকবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আসিতে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা-তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না। তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারেই নেই, এ কথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টর সাহেব যখন স্কুল দেখিতে আসেন--- তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য সে চীত্কার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমতো শাস্তি পাইতাম। কিন্তু দাশু `পাগলা' বলিয়া কেহ তাহাকে কিছু বলিল না।
ছুটির পরে দাশু নূতন কি পাগলামি করে, তাহা দেখিবার জন্য আমরা ব্যস্ত হইয়া স্কুলে আসিতাম। কিন্তু যেবার সে অদ্ভুত এক বাক্স বগলে লইয়া ক্লাশে হাজির হইল, তখন আমরা বাস্তবিকই আশ্চর্য হইয়াছিলাম্। আমাদের মাস্টারমহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ``কি হে দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি এনেছ?'' দাশু বলিল, ``আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।'' `জিনিসপত্র'টা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটু তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি, সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি রে বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, ``খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।'' তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতরে চাহিয়া কি যেন দেখিয়া লইল এবং `ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড়্বিড়্ করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম---অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।
ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, ``ওটা ওর টিফিনের বাক্স--- ওর মধ্যে খাবার আছে।'' কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, ``ওটা বোধ হয় ওর মানিব্যাগ--- ওর মধ্যে টাকাপয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়।'' আরেকজন বলিল, ``টাকাপয়সার জন্য অত বড়ো বাক্স কেন? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি?''
একদিন টিফিনের সময়ে দাশু হঠাত্ ব্যস্ত হইয়া বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, ``এটা এখন তোমার কাছে রাখ, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে--- তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দরোয়ানের কাছে দিয়ে দিয়ো।'' এই কথা বলিয়া সে বাক্সটা দরোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উত্সাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন হতভাগা দরোয়ানটা একটু তফাত্ গেলেই হয়। খানিকবাদে দরোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া কতকগুলা বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। দরোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি, বাক্সের মধ্যে বেশ ভারী একটা কাগজের পোঁটলা নেকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তার পর তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখ গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স--- তার ভিতরে আরেকটি ছোট পোঁটলা। সেইটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার একপিঠে লেখা `কাঁচকলা খাও' আরেকটি পিঠে লেখা `অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়'। দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, ``ছোকরা আচ্ছা যাহোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।'' আরেকজন বলিল, ``যেমনভাবে বাঁধা ছিল, তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টের না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তা হলে সে নিজেই জব্দ হবে।'' আমি বলিলাম, ``বেশ কথা, ও ছোকরা আসলে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বোলো আর ওর মধ্যে কি আছে--- সেটা বার করে জানতে চেয়ো।'' তখন আমরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।
বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শুনা গেল--- চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপর বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপিচুপি তামাশা দেখিতেছিল। আর আমাদের কথাবার্তা সমস্ত শুনিতেছিল! তখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দরোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময়ে বাইরে যাওয়ার ভান করা, এ-সমস্তই তাহার শয়তানি। আসল মতলবটি, আমাদের খানিকটা নাচাইয়া তামাশা দেখানো। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই, সে মিছামিছি এ কয়দিন ধরিয়া ক্রমাগত একটা বাক্স, বহিয়া বেড়াইয়াছে।
সাধে কি বলি পাগলা দাশু?
ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।
সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত-পা ছোঁড়ার ভঙ্গি দেখিয়া হঠাত্ চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।
সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা-লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক-এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত, যে আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।
দাশু, অর্থাত্ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের ক্লাশের `ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশুনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি পড়া জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু পড়া বলিয়া দেওয়া দূরে থাকুক, তাহাকে বেশ দু কথা শোনাইয়া বলিল, ``আমার বুঝি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আজ এঁকে ইংরিজি বোঝাব, কাল ওঁর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আরেকজন আসবেন আরেক ফরমাইস নিয়ে--- ঐ করি আর কি!'' দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, ``তুমি তো ভারি চ্যাঁচড়া ছোটোলোক হে!'' জগবন্ধু পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে নালিশ করিল, ঐ নতুন ছেলেটা আমাকে গালাগালি দিচ্ছে।'' পণ্ডিতমহাশয় দাশুকে এমনি দু-চার ধমক দিয়া দিলেন যে, সে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।
তার পর কয়দিন দাশু জগবন্ধুর সহিত কথাবার্তা কহে নাই। পণ্ডিতমহাশয় রোজ ক্লাশে আসেন, আর যখন দরকার হয়, জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় উপক্রমণিকা চাহিলেন, জগবন্ধু তা।ড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া উপক্রমণিকাখানা বাহির করিয়া দিল। পণ্ডিতমহাশয় বইখানি খুলিয়াই হথাত্ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ``বইখানা কার?'' জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, ``আমার।'' পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, ``হুঁ---নূতন সংস্করণ বুঝি? বইকে বই একেবারে বদলে গেছে।'' এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন, ``যশোবন্ত দারোগা--- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক।'' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। পণ্ডিতমহাশয় বিকটরকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, ``স্কুলে আমার আদুরে গোপাল, আর বাড়িতে বুঝি নৃসিংহ অবতার?'' জগবন্ধু আম্তা-আম্তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, ``থাক, থাক, আর ভালোমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই---ঢের হয়েছে।'' লজ্জায়, অপমানে জগবন্ধুর দুই কান লাল হৈয়া উঠিল---আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটি দাশুভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।
দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা করিতাম। তাহাতে বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইত যেন সে বেশ আমোদ পাইতেছে। একেক সমযে সে নিজেই উত্সাহ করিয়া আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত! একদিন সে বলিল, ``ভাই, আমাদের পাড়ায় যখনই কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস?'' আমরা বলিলাম, ``খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি?'' সে বলিল, ``তা নয়। যখন আমসত্ত্ব শুকোতে দেয় আমি সেইখানে ছাদের ওপর বার দুয়েক এই চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে যত কাক সব `ত্রাহি ত্রাহি' করে ছুটে পালায়। কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।''
প্রত্যেকবার ছুটির পরে স্কুলে ফিরিবার সময় দাশু একটা-না-একটা কাণ্ড বাধাইয়া আসে। একবার সে হঠাত্ পেণ্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢলঢলে পায়জামার মতো পেণ্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ``পেণ্টেলুন পরেছিস কেন?'' দাশু একগাল হাসিয়া বলিল, ``ভালো করে ইংরাজি শিখব বলে।'' আরেকবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আসিতে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা-তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না। তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারেই নেই, এ কথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টর সাহেব যখন স্কুল দেখিতে আসেন--- তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য সে চীত্কার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমতো শাস্তি পাইতাম। কিন্তু দাশু `পাগলা' বলিয়া কেহ তাহাকে কিছু বলিল না।
ছুটির পরে দাশু নূতন কি পাগলামি করে, তাহা দেখিবার জন্য আমরা ব্যস্ত হইয়া স্কুলে আসিতাম। কিন্তু যেবার সে অদ্ভুত এক বাক্স বগলে লইয়া ক্লাশে হাজির হইল, তখন আমরা বাস্তবিকই আশ্চর্য হইয়াছিলাম্। আমাদের মাস্টারমহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ``কি হে দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি এনেছ?'' দাশু বলিল, ``আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।'' `জিনিসপত্র'টা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটু তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি, সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি রে বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, ``খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।'' তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতরে চাহিয়া কি যেন দেখিয়া লইল এবং `ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড়্বিড়্ করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম---অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।
ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, ``ওটা ওর টিফিনের বাক্স--- ওর মধ্যে খাবার আছে।'' কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, ``ওটা বোধ হয় ওর মানিব্যাগ--- ওর মধ্যে টাকাপয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়।'' আরেকজন বলিল, ``টাকাপয়সার জন্য অত বড়ো বাক্স কেন? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি?''
একদিন টিফিনের সময়ে দাশু হঠাত্ ব্যস্ত হইয়া বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, ``এটা এখন তোমার কাছে রাখ, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে--- তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দরোয়ানের কাছে দিয়ে দিয়ো।'' এই কথা বলিয়া সে বাক্সটা দরোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উত্সাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন হতভাগা দরোয়ানটা একটু তফাত্ গেলেই হয়। খানিকবাদে দরোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া কতকগুলা বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। দরোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি, বাক্সের মধ্যে বেশ ভারী একটা কাগজের পোঁটলা নেকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তার পর তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখ গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স--- তার ভিতরে আরেকটি ছোট পোঁটলা। সেইটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার একপিঠে লেখা `কাঁচকলা খাও' আরেকটি পিঠে লেখা `অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়'। দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, ``ছোকরা আচ্ছা যাহোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।'' আরেকজন বলিল, ``যেমনভাবে বাঁধা ছিল, তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টের না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তা হলে সে নিজেই জব্দ হবে।'' আমি বলিলাম, ``বেশ কথা, ও ছোকরা আসলে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বোলো আর ওর মধ্যে কি আছে--- সেটা বার করে জানতে চেয়ো।'' তখন আমরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।
বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শুনা গেল--- চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপর বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপিচুপি তামাশা দেখিতেছিল। আর আমাদের কথাবার্তা সমস্ত শুনিতেছিল! তখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দরোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময়ে বাইরে যাওয়ার ভান করা, এ-সমস্তই তাহার শয়তানি। আসল মতলবটি, আমাদের খানিকটা নাচাইয়া তামাশা দেখানো। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই, সে মিছামিছি এ কয়দিন ধরিয়া ক্রমাগত একটা বাক্স, বহিয়া বেড়াইয়াছে।
সাধে কি বলি পাগলা দাশু?
হ য ব র ল
হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেই যদি দেখো তোমার রুমালটা একটা মোটা সোটা লাল টকটকে বেড়াল হয়ে গেছে, কেমন লাগবে? শুধু তাই না, তোমার রুমাল থেকে হওয়া বিড়ালটা যদি এরপর তোমাকেই বোকা বানিয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে হাসতে বেড়া টপকে পালিয়ে যায়, তখনই বা বিষয়টি কেমন হবে? অথচ এমনই সব ঘটনাই ঘটে সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-এর ছেলেটার।
বেড়ালের পর ছেলেটার সাথে দেখা হয় এক আজব কাকের। নাম তার শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে। সারাক্ষণ খালি সব হিসাব কষতে থাকে। আর সেখানকার হিসাবও কী অদ্ভূত। আমাদের সবারই তো কেবল বয়স বাড়ে, তাই না? ওদের ওখানে নাকি বয়স আবার কমেও। বয়স ৪০ হলে আবার উল্টোদিকে গোনা শুরু করে সবাই। আবার ১০ হলে বাড়াতে থাকে। আবার মনে করো, সাত দুগুণে চৌদ্দ, এ তো তোমরা সবাই জানো। ওখানে কিন্তু হিসাবটা এত্তো সোজা নয়। একদম ঠিক সময়ে যদি তুমি চৌদ্দ না লিখতে পারো, তাহলেই সেরেছে। দেখা যাবে ততক্ষণে হিসাবটা হয়ে গেছে চৌদ্দ টাকা এক আনা নয় পাই।
এরপর দেখা হয় দুই বুড়োর সাথে। দুজনেই দেখতে একরকম। একজনের নাম উধো, অন্যজনের নাম বুধো। দেড়হাত লম্বা, পা পর্যন্ত সবুজ দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে আবার কলকি-টলকি কিছু নেই আর মাথা ভরা টাক। এই দুজন মারামারি করে ফের আবার গলাগলি করে কাঁদে। আর কাঁদে একেবারে বাচ্চাদের মতো। ওদের বয়স কতো জানো? ১৩ বছর। মনে করো না, ওরা ছোট। ওদের বয়স কিভাবে হিসাব করে ভুলে গেছো?
এরপর ছেলেটার সাথে দেখা হয় এক আজব জন্তুর- মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, কিচ্ছু বোঝা যায় না। খালি আজব আজব চিন্তা করে আর ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে হাসতে পেট ফাটিয়ে ফেলে। নাম তার হিজিবিজবিজ। ওর সাথে কথা বলতে বলতেই আসে এক দাড়িওয়ালা রামছাগল। শ্রীব্যাকরণশিং, বি.এ. খাদ্যবিশারদ। কোন কোন জিনিস খাওয়া যায় আর কোন কোনটা খাওয়া যায় না তা সব পরীক্ষা করে দেখেছে বলেই তার খাদ্যবিশারদ উপাধি। সে তো সুযোগ বুঝে ছাগলের খাওয়া দাওয়া নিয়ে এক বিশাল বক্তৃতাই দিয়ে দিলো।
এরপর কোত্থেকে এলো নেড়ামাথা অদ্ভূত চাপকান আর পায়জামা পরা এক লোক। নিজে নিজেই ‘গাইতে পারবো না’, ‘গলা খুলবে না’ বলতে বলতে গান গাইতে শুরু করে দিলো। আর গানও কী- একটাই লাইন সে পাঁচবার দশবার করে গাইতে লাগলো। লাইনটাই বা কী দেখো না- ‘লাল গানে নীল সুর, হাসি-হাসি গন্ধ।’
তখন আবার শুরু হলো এক বিচার। চারপাশে ভীড় জমে গেলো। তার মাঝে বসে বসে সজারু কেবল ফোঁৎফোঁৎ করে কাঁদতে লাগলো। উকিল হলো এক কুমির। শামলা পরে মস্ত এক বই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচারক তকমা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা এক কোলা ব্যাঙ। সে রুল উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো- ‘মানহানির মোকদ্দমা’। একেবারে মহা বিপদ! তো সেই মোকদ্দমায় শেষপর্যন্ত কি হলো? ছেলেটা কি ওখানেই থেকে গেলো, না আবারো আমাদের এই স্বাভাবিক জগতে ফিরে আসতে পেরেছিলো? জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? তাহলে পড়েই ফেলো সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’। আর বইটা পড়ে যদি ভালো লেগে যায়, তবে শীগগির করে সুকুমার রায়ের বাকি বইগুলোও পড়ে ফেলো। কারণ যে সুকুমার রায়ের বই পড়েনি, তাকে বোঝানো যাবে না, তার বই পড়তে কতো মজা!
লিঙ্কঃ http://kidz.bdnews24.com/kiDekhbeKiPorbe.php?kiporbeid=44&kiporbekidekhbeid=1
বেজায় গরম । গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির । ঘাসের উপর রুমালটা ছিল ; ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি, অমনি রুমালটা বলল, 'ম্যাও !' কি আপদ ! রুমালটা ম্যাও করে কেন ?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি বললাম, 'কি মুশকিল ! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল ।'
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, 'মুশকিল আবার কি ? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস । এ তো হামেশাই হচ্ছে ।'
আমি খানিক ভেবে বললাম, 'তাহলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব ? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল ।'
বেড়াল বলল, 'বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার ।' আমি বললাম, 'চন্দ্রবিন্দু কেন ?'
বেড়াল বলল, 'তাও জানো না?' ব'লে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে বিশ্রী রকম হাসতে লাগল । আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । মনে হল, ঐ চন্দ্রবিন্দুর কথাটা নিশ্চই আমার বোঝা উচিৎ ছিল । তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, 'ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি ।'
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, 'হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে- চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা- হল চশমা । কেমন, হল তো ?'
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেই রকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ হুঁ করে গেলাম । তারপর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, 'গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার ।' আমি বললাম, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না ?'
বেড়াল বলল, 'কেন ? সে আর মুশকিল কি ?'
আমি বললাম, 'কি করে যেতে হয় তুমি জানো ?'
বেড়াল একগাল হেসে বলল, 'তা আর জানিনে ? কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, তিব্বত,- ব্যাস্ ! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল ।'
আমি বললাম, 'তাহলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার ?'
শুনে বেড়ালটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর মাথা নেড়ে বলল, 'উহুঁ সে আমার কর্ম নয় । আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক বলতে পারত ।'
আমি বললাম, 'গেছো দাদা কে ? তিনি থাকেন কোথায় ?'
বেড়াল বলল, 'গেছো দাদা আবার কোথায় থাকবে ? গাছেই থাকে ।'
আমি বললাম, 'কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ?'
বেড়াল খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, 'সেটি হচ্ছে না, সে হবার যো নেই ।'
আমি বললাম, 'কি রকম ?'
বেড়াল বলল, 'সে কি রকম জানো ? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি । যদি মতিহারি যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর । আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেলেন কাশিমবাজার । কিছুতেই দেখা হবার যো নেই ।'
আমি বললাম, তাহলে তোমরা কি করে দেখা কর ?'
বেড়াল বলল, 'সে অনেক হাঙ্গামা । আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই ; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে ; তারপর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে । তারপর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, তখন দাদা কোথায় থাকবে । তারপর দেখতে হবে-'
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, 'সে কি রকম হিসেব ?'
বেড়াল বলল, 'সে ভারি শক্ত । দেখবে কি রকম ?' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর গেছোদাদা ।' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল ।
তারপর আবার ঠিক তেমনি আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর তুমি,' বলে ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে রইল ।
তারপর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু ।' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, 'এই মনে কর তিব্বত'- 'এই মনে কর গেছোবৌদি রান্না করছে'- 'এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো-'
এই রকম শুনতে শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল । আমি বললাম, 'দূর ছাই ! কি সব আবোল-তাবোল বকছ, একটুও ভালো লাগে না ।'
বেড়াল বলল, 'আচ্ছা তাহলে আর একটু সহজ করে বলছি । চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর ।' আমি চোখ বুজলাম ।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোন সাড়া-শব্দ নেই । হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে হাসছে ।
কি আর করি, গাছ তলায় একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম । বসতেই কে যেন ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, 'সাত দুগুণে কত হয় ?'
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে ? এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, 'কই জবাব দিচ্ছ না যে ? সাত দুগুণে কত হয় ?' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক একবার ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে ।
আমি বললাম, 'সাত দুগুণে চোদ্দ ।'
কাকটা অমনি দুলে দুলে মাথা নেড়ে বলল, 'হয়নি, হয়নি, ফেল্ ।'
আমার ভয়ানক রাগ হল । বললাম, 'নিশ্চয় হয়েছে । সাতেক্কে সাত, সাত দুগুণে চোদ্দ, তিন সাত্তে একুশ ।'
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল ।
তারপরে বলল, 'সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার, হাতে রইল পেনসিল ।'
আমি বললাম, 'তবে যে বলছিলে সাত দুগুণে চোদ্দ হয় না ? এখন কেন ?'
কাক বলল, 'তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো চোদ্দ হয়নি । তখন ছিল, তেরো টাকা চোদ্দ আনা তিন পাই । আমি যদি ঠিক সময়ে বুঝে ধাঁ করে ১৪ লিখে না ফেলতাম, তাহলে এতক্ষণে হয়ে যেত চোদ্দ টাকা এক আনা নয় পাই ।'
আমি বললাম, 'এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনিনি । সাত দুগুণে যদি চোদ্দ হয়, তা সে সব সময়েই চোদ্দ । একঘণ্টা আগে হলেও যা, দশ দিন পরে হলেও তাই ।'
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, 'তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি ?'
আমি বললাম, 'সময়ের দাম কি রকম ?'
কাক বলল, 'এখানে কদিন থাকতে, তাহলে বুঝতে । আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করবার যো নেই । এইতো কদিন আগে খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটা সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল ।' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল । আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম ।
এমন সময় গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুৎ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল । চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো, তাতে কল্কে-টল্কে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক । টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি সব লিখেছে ।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, 'কই, হিসেবটা হল ?'
কাক খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, 'এই হল বলে ।'
বুড়ো বলল, 'কি আশ্চর্য ! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না ?' কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'কতদিন বললে ?'
বুড়ো বলল, 'উনিশ ।'
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, 'লাগ্ লাগ্ লাগ্ কুড়ি ।'
বুড়ো বলল, 'একুশ ।' কাক বলল, 'বাইশ ।' বুড়ো বলল, 'তেইশ ।' কাক বলল, 'সাড়ে তেইশ ।' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে । ডাকতে ডাকতে কাকটা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'তুমি ডাকছ না যে ?' আমি বললাম, 'খামখা ডাকতে যাব কেন ?'
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখেনি, হঠাৎ আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্ বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল । তারপর হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে আনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল । তারপর কোত্থেকে একটা পুরানো দরজীর ফিতে এনে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, 'খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, ছাতি ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি ।'
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, 'এ হতেই পারে না । বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি ? আমি কি শুওর ?'
বুড়ো বলল, 'বিশ্বাস না হয়, দেখ ।' দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায় ।
তারপর বুড়ো জিজ্ঞেস করল, 'ওজন কত ?'
আমি বললাম, 'জানি না ।'
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে টিপে বলল, 'আড়াই সের ।' আমি বললাম, 'সেকি, পটলার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোট ।' কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, 'সে তোমাদের হিসেব অন্য রকম ।'
বুড়ো বলল, 'তাহলে লিখে নাও- ওজন আড়াই সের, বয়স সাঁইত্রিশ ।'
আমি বললাম, 'দুৎ ! আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা সাঁইত্রিশ ।'
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, 'বাড়তি না কমতি ?' আমি বললাম, 'সে আবার কি ?'
বুড়ো বলল, 'বলি বয়েসটা এখন কমছে না বাড়ছে ?' আমি বললাম, 'বয়েস আবার কমবে কি ?' বুড়ো বলল, 'তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি ? তাহলেই তো গেছি । কোনদিন দেখবে বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি পার হয়ে গেছে । শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি !'
আমি বললাম, 'তা তো হবেই । আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না ?' বুড়ো বলল, 'তোমার যেমন বুদ্ধি ! আশি বছর বয়েস হবে কেন ? চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই । তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না- উনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে । এমনি করে যখন দশ পর্যন্ত নামে তখন আবার বয়েস বাড়তে দেওয়া হয় । আমার বয়েস তো কত উঠল নামল আবার উঠল, এখন আমার বয়েস হয়েছে তেরো ।' শুনে আমার ভয়ানক হাসি পেয়ে গেল ।
কাক বলল, 'তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি ।'
বুড়ো অমনি চট্ করে আমার পাশে এসে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ফিস্ ফিস্ করে বলতে লাগল, 'একটি চমৎকার গল্প বলব । দাঁড়াও একটু ভেবে নি ।' এই বলে তার হুঁকো দিয়ে টেকো মাথা চুলকাতে চুলকাতে চোখ বুজে ভাবতে লাগল । তারপর হঠাৎ বলে উঠল, 'হ্যাঁ, মনে হয়েছে, শোনো-
'তারপর এদিকে বড়মন্ত্রী তো রাজকন্যার গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে । কেউ কিচ্ছু জানে না । ওদিকে রাক্ষসটা করেছে কি, ঘুমুতে ঘুমুতে হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ বলে হুড়্মুড়্ করে খাট থেকে পড়ে গিয়েছে । অমনি ঢাক ঢোল সানাই কাঁশি লোক লস্কর সেপাই পল্টন হৈ-হৈ রৈ-রৈ মার্-মার্ কাট্-কাট্- এর মধ্যে হঠাৎ রাজা বলে উঠলেন, পক্ষীরাজ যদি হবে, তাহলে ন্যাজ নেই কেন ? শুনে পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার আক্কেল মক্কেল সবাই বললে, ভালো কথা ! ন্যাজ কি হল ? কেউ তার জবাব দিতে পারে না, সব সুড়্সুড়্ করে পালাতে লাগল ।'
এমন সময় কাকটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'বিজ্ঞাপন পেয়েছ ? হ্যান্ডবিল ?'
আমি বললাম, 'কই না, কিসের বিজ্ঞাপন ?' বলতেই কাকটা একটা কাগজের বন্ডিল থেকে একখানা ছাপানো কাগজ বের করে হাতে দিল, আমি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে-
শ্রীশ্রীভূষণ্ডি কাগায় নমঃ
শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে
৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি
আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা ও পাইকারী সকল প্রকার গণনার কার্য্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি । মূল্য এক ইঞ্চি ১|/০ । Children Half price, অর্থাৎ শিশুদের অর্দ্ধমূল্য । আপনার জুতার মাপ, গায়ের রং, কান কট্কট্ করে কিনা, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ পাঠাইলেই ফেরত ডাকে ক্যাটালগ্ পাঠাইয়া থাকি ।
সাবধান ! সাবধান !! সাবধান !!!
আমরা সনাতন বায়স বংশীয় দাঁড়ি কুলীন, অর্থাৎ দাঁড়কাক । আজকাল নানাশ্রেনীর পাতি কাক, হেড়ে কাক, রাম কাক প্রভৃতি নীচশ্রেণীর কাকেরাও অর্থলোভে নানারূপ ব্যবসা চালাইতেছে । সাবধান ! তাহাদের বিজ্ঞাপনের চটক দেখিয়া প্রতারিত হইবেন না ।
আমি বললাম, 'সবটা ভালো করে বোঝা গেল না ।'
কাক গম্ভীর হয়ে বলল, 'হ্যাঁ, ভারি শক্ত, সকলে বুঝতে পারে না । একবার এক খদ্দের এয়েছিল, তার ছিল টেকো মাথা-'
এই কথা বলতেই বুড়ো মাৎ-মাৎ করে তেড়ে উঠে বলল, 'দেখ ! ফের যদি টেকো মাথা বলবি তো হুঁকো দিয়ে এক বাড়ি মেরে তোর শ্লেট ফাটিয়ে দেব ।' কাক একটু থতমত খেয়ে কি যেন ভাবল, তারপর বলল, 'টেকো নয়, টেপো মাথা, যে মাথা টিপে টিপে টোল খেয়ে গিয়েছে ।'
বুড়ো তাতেও ঠাণ্ডা হল না, বসে বসে গজ্গজ্ করতে লাগল । তাই দেখে কাক বলল, 'হিসেবটা দেখবে নাকি ?' বুড়ো একটু নরম হয়ে বলল, 'হয়ে গেছে ? কই দেখি ।' কাক অমনি 'এই দেখ' বলে তার শ্লেটখানা ঠকাস্ করে বুড়োর টাকের উপর ফেলে দিল । বুড়ো তৎক্ষণাৎ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল আর ছোট ছেলেদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে 'ও মা, ও পিসি, ও শিবুদা' বলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল ।
কাকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, 'লাগল নাকি ! ষাট ষাট ।' বুড়ো অমনি কান্না থামিয়ে বলল, 'একষট্টি, বাষট্টি -' কাক বলল, 'পঁয়ষট্টি ।'
আমি দেখলাম আবার বুঝি ডাকাডাকি শুরু হয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, 'কই হিসেবটা তো দেখলে না ?"
বুড়ো বলল, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, তাইতো ! কি হিসেব হল পড় দেখি ।' আমি শ্লেটখানা তুলে দেখলাম খুদে খুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে- 'ইয়াদি কির্দ অত্র কাকালতনামা লিখিতং শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে কার্যঞ্চাগে । ইমারৎ খেসারৎ দলিল দস্তাবেজ । তস্য ওয়ারিশাগণ মালিক দখলিকার সত্ত্বে অত্র নায়েব সেরেস্তায় দস্ত বদস্ত কায়েম মোকরবী পত্তনী পাট্টা অথবা কাওলা কবুলিয়ৎ । সত্যতায় কি বিনা সত্যতায় মুনসেফী আদালতে কিম্বা দায়রায় সোপর্দ আসামী ফরিয়াদী সাক্ষী সাবুদ গয়রহ মোকর্দমা দায়ের কিম্বা আপোস মকমল ডিক্রীজারী নিলাম ইস্তাহার ইত্যাদি সর্বপ্রকার কর্তব্য বিধায়-'
আমার পড়া শেষ না হতেই বুড়ো বলে উঠল, 'এসব কি লিখেছ আবোল-তাবোল ?' কাক বলল, 'ওসব লিখতে হয় । তা না হলে হিসেব টিকবে কেন ? ঠিক চৌকসমত কাজ করতে হলে গোড়ায় এসব বলে নিতে হয় ।' বুড়ো বলল, 'তা বেশ করেছ, কিন্তু আসল হিসেবটা কি হল তা তো বললে না ?' কাক বলল, 'হ্যাঁ, তাও বলা হয়েছে । ওহে শেষ দিকটা পড় তো ?'
আমি দেখলাম, শেষের দিকে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে-
সাত দুগুণে চোদ্দ, বয়স ছাব্বিশ ইঞ্চি, জমা /২।।সের, খরচ ৩৭ বৎসর ।
কাক বলল, 'দেখেই বোঝা যাচ্ছে অঙ্কটা এল্-সি-এম্ও নয়, জি-সি-এম্ও নয় । সুতরাং হয় এটা ত্রৈরাশিকের অঙ্ক, না হয় ভগ্নাংশ । পরীক্ষা করে দেখলাম, আড়াই সেরটা হচ্ছে ভগ্নাংশ । তাহলে বাকি তিনটে হল ত্রৈরাশিক । এখন আমার জানা দরকার, তোমরা ত্রৈরাশিক চাও, না ভগ্নাংশ চাও ?'
বুড়ো বলল, 'আচ্ছা দাঁড়াও, তাহলে একবার জিগ্গেস করে নি ।' এই বলে সে নিচু হয়ে গাছের গোড়ায় মুখ ঠেকিয়ে ডাকতে লাগল, 'ওরে বুধো ! বুধো রে !'
খানিক পরে মনে হল কে যেন গাছের ভিতর থেকে রেগে বলে উঠল, 'কেন ডাকছিস ?' বুড়ো বলল, 'কাক্কেশ্বর কি বলছে শোন্ ।'
আবার সেই রকম আওয়াজ হল, 'কি বলছে ?' বুড়ো বলল, 'বলছে ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ ?' তেড়ে উত্তর হল, 'কাকে বলছে ভগ্নাংশ, তোকে না আমাকে ?' বুডো বলল, 'তা নয় । বলছে হিসেবটা ভগ্নাংশ চাস, না ত্রৈরাশিক ।'
একটুক্ষণ পরে জবাব শোনা গেল, 'আচ্ছা ত্রৈরাশিকে দিতে বল ।'
বুড়ো গম্ভীর ভাবে খানিকক্ষণ দাড়ি হাতরাল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, 'বুধোটার যেমন বুদ্ধি ! ত্রৈরাশিকে দিতে বলব কেন ? ভগ্নাংশটা খারাপ হল কিসে ? না হে কাক্কেশ্বর, তুমি ভগ্নাংশই দাও ।' কাক বলল, 'তাহলে আড়াই সেরের গোটা সের দুটো বাদ দিলে রইল ভগ্নাংশ আধ সের, তোমার হিসেব হল আধ সের । আধ সের হিসেবের দাম পড়ে- খাঁটি হলে দু টাকা চোদ্দ আনা, আর জল মেশানো থাকলে ছয় পয়সা ।'
বুড়ো বলল, 'আমি যখন কাঁদছিলাম, তখন তিন ফোঁটা জল হিসেবের মধ্যে পড়েছিল । এই নাও তোমার শ্লেট, আর এই নাও তোমার পয়সা ছটা ।' পয়সা পেয়ে কাকের মহা ফুর্তি ! সে 'টাক্-ডুমাডুম্ টাক্-ডুমাডুম্' বলে শ্লেট বাজিয়ে নাচতে লাগল ।
বুড়ো অমনি আবার তেড়ে উঠল, 'ফের টাক্ টাক্ বলছিস ? দাঁড়া । ওরে বুধো, বুধো রে ! শিগগির আয় । আবার টাক্ বলছে । বলতে-না-বলতেই গাছের ফোকর থেকে মস্ত একটা পোঁটলা মতন কি যেন হুড়্মুড়্ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল । চেয়ে দেখলাম, একটা বুড়ো লোক একটা প্রকাণ্ড বোঁচকার নিচে চাপা পড়ে ব্যস্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে । বুড়োটা দেখতে অবিকল এই হুঁকোওয়ালা বুড়োর মতো । হুঁকোওয়ালা কোথায় তাকে টেনে তুলবে, না সে নিজেই পোঁটলার উপর চড়ে বসে, 'ওঠ বলছি, শিগগির ওঠ্' বলে ধাঁই করে তাকে হুঁকো দিয়ে মারতে লাগল । কাক আমার দিকে চোখ মট্কিয়ে বলল, 'ব্যাপারটা বুঝতে
পারছ না? উধোর বঝা বুধোর ঘাড়ে । এর বোঝা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, এখন ও আর বোঝা ছাড়তে চাইবে কেন ? এই নিয়ে রোজ মারামারি হয় ।'
এই কথা বলতে বলতেই চেয়ে দেখি, বুধো তার পোঁটলা শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে । দাঁড়িয়েই সে পোঁটলা উঁচিয়ে দাঁত কড়মড় করে বলল, 'তবে রে ইসটুপিড উধো !' উধোও আস্তিন গুটিয়ে হুঁকো বাগিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, 'তবে রে লক্ষ্ণীছাড়া বুধো !'
কাক বলল, 'লেগে যা- নারদ নারদ !'
অমনি ঝটাপট্, খটাপট্, দমাদম্, ধপাধপ্ ! মুহূর্তের মধ্যে চেয়ে দেখি উধো চিৎপাত শুয়ে হাঁপাচ্ছে, আর বুধো ছট্ফট্ করে টাকে হাত বুলোচ্ছে ।
বুধো কান্না শুরু করল, 'ওরে ভাই উধো রে, তুই এখন কোথায় গেলি রে ?' উধো কাঁদতে লাগল, 'ওরে হায় হায় । আমাদের কি হল রে !' তারপর দুজনে উঠে খুব খানিক গলা জড়িয়ে কেঁদে, আর খুব খানিক কোলাকুলি করে, দিব্যি খোশমেজাজে গাছের ফোকরের মধ্যে ঢুকে পড়ল । তাই দেখে কাকটাও তার দোকানপাট বন্ধ করে কোথায় যেন চলে গেল ।
আমি ভাবছি এই বেলা পথ খুঁজে বাড়ি ফেরা যাক, এমন সময় শুনি পাশেই একটা ঝোপের মধ্যে কি রকম শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ হাসতে হাসতে আর কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না । উঁকি মেরে দেখি, একটা জন্তু- মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না- খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর বলছে, 'এই গেল গেল- নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল ।'
হঠাৎ আমায় দেখে সে একটু দ্ম পেয়ে উঠে বলল, 'ভাগ্যিস তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাচ্ছিল ।'
আমি বললাম, 'তুমি এমন সাংঘাতিক রকম হাসছ কেন ?'
জন্তুটা বলল, 'কেন হাসছি শুনবে ? মনে কর, পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হত, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচ্ প্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তার মধ্যে ধপাধপ্ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে- হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ-' এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল ।
আমি বললাম, 'কি আশ্চর্য ! এর জন্য তুমি এত ভয়ানক করে হাসছ ?'
সে আবার হাসি থামিয়ে বলল, 'না, না, শুধু এর জন্য নয় । মনে কর, একজন লোক আসছে, তার এক হাতে কুলপি বরফ, আর এক হাতে সাজিমাটি, আর লোকটা কুলপি খেতে গিয়ে ভুলে সাজিমাটি খেয়ে ফেলেছে- হোঃ হোঃ হোঃ হো হাঃ হাঃ হাঃ হা-' আবার সে হাসির পালা ।
আমি বললাম, 'কেন তুমি এই সব অসম্ভব কথা ভেবে খামকা হেসে হেসে কষ্ট পাচ্ছ ?' সে বলল, 'না, না, সব কি আর অসম্ভব ? মনে কর, একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে- হোঃ হোঃ হোঃ হো-'
জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল । আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'তুমি কে ? তোমার নাম কি?' সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, 'আমার নাম হিজিবিজ্বিজ্ । আমার নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার ভায়ের নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার বাবার নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার পিশের নাম হিজিবিজ্বিজ্-' আমি বললাম, 'তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিশুদ্ধ সবাই হিজিবিজ্বিজ্ ।'
সে আবার খানিক ভেবে বলল, 'তা তো নয়, আমার মামার নাম তকাই । আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেশোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই-'
আমি ধ্মল দিয়ে বললাম, 'সত্যি বলছ ? না, বানিয়ে ?' জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, 'না না, আমার শ্বশুরের নাম বিস্কুট ।' আমার ভয়ানক রাগ হল, তেড়ে বললাম, 'একটা কথাও বিশ্বাস করি না ।'
অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে মস্ত একটা দাড়িওয়ালা ছাগল হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, 'আমার কথা হচ্ছে বুঝি ?'
আমি বলতে যাচ্ছিলাম 'না' কিন্তু কিছু না বলতেই সে তড়তড় করে বলে যেতে লাগল, 'তা তোমরা যতই তর্ক কর, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না । তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে- 'ছাগলে কি না খায় ।' এই বলে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল-
'হে বালকবৃন্দ এবং স্নেহের হিজিবিজ্বিজ্, আমার গলায় ঝুলানো সার্টিফিকেট দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রীব্যাকরণ শিং, বি. এ. খাদ্য বিশারদ । আমি খুব চমৎকার ব্যা করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ, আর শিং তো দেখতেই পাচ্ছ । ইংরিজিতে লিখবার সময় লিখি B. A. অর্থাৎ ব্যা । কোন্-কোন্ জিনিস খাওয়া যায় আর কোন্টা-কোন্টা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যবিশারদ । তোমরা যে বল- পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়- এটা অত্যন্ত অন্যায় । এই তো একটু আগে ঐ হতভাগাটা বলছিল যে রামছাগল টিকটিকি খায় । এটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা । আমি অনেক রকম টিকটিকি চেটে দেখেছি, ওতে খাবার মত কিচ্ছু নেই । অবশ্যি আমরা মাঝে মাঝে এমন অনেক জিনিস খাই যা তোমরা খাও না, যেমন- খাবারের ঠোঙা, কিম্বা নারকেলের ছোবড়া, কিম্বা খবরের কাগজ, কিম্বা সন্দেশের মতো ভালো ভালো অনেক মাসিক পত্রিকা । কিন্তু তা বলে মজবুত বাঁধানো কোনো বই আমরা কক্ষনো খাই না । আমরা কচিৎ কখনো লেপ কিম্বা তোশক বালিশ এসব একটু আধটু খাই বটে, কিন্তু যারা বলে আমরা খাট পালং কিম্বা টেবিল চেয়ার খাই, তারা ভয়ানক মিথ্যাবাদী ।
যখন আমাদের মনে খুব তেজ আসে, তখন শখ করে অনেক রকম জিনিস আমরা চিবিয়ে কিম্বা চেখে দেখি,- যেমন, পেনসিল রবার কিম্বা বোতলের ছিপি কিম্বা শুকনো জুতো কিম্বা ক্যামবিসের ব্যাগ । শুনেছি আমার ঠাকুরদাদা একবার ফুর্তির চোটে এক সাহেবের আধখানা তাঁবু প্রায় খেয়ে শেষ করে ছিলেন । কিন্তু তা বলে ছুরি কাঁচি কিম্বা শিশি বোতল, এ সব আমরা কোনদিন খাই না । কেউ কেউ সাবান খেতে ভালোবাসে, কিন্তু সে সব নেহাৎ ছোটখাট বাজে সাবান । আমার ছোটভাই একবার একটা আস্ত বার্-সোপ খেয়ে ফেলেছিল-' বলেই ব্যাকরণ শিং আকাশের দিকে চোখ তুলে ব্যা ব্যা করে ভয়ানক কাঁদতে লাগল । তাতে বুঝতে পারলাম যে সাবান খেয়ে ভাইটির অকালমৃত্যু হয়েছে । হিজিবিজ্বিজ্টা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ ছাগলটার বিকট কান্না শুনে সে হাঁউ-মাঁউ করে ধড়মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির ! আমি ভাবলাম বোকাটা মরে বুঝি এবার ! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা ছুঁড়ে ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে হাসতে লেগেছে ।
আমি বললাম, 'এর মধ্যে আবার হাসবার কি হল ?' সে বলল, 'সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝে মাঝে এমন ভয়ঙ্কর নাক ডাকাত, যে, সবাই তার উপর চটা ছিল । একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম্ মারতে লেগেছে- হোঃ হোঃ হোঃ হো-'
আমি বললাম, 'যত সব বাজে কথা ।' এই বলে যেই ফিরতে গেছি, অমনি চেয়ে দেখি একটা নেড়া মাথা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । দেখে আমার গা জ্বলে গেল । আমায় ফিরতে দেখেই সে আব্দার করে আহ্লাদীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দুহাত নেড়ে বলতে লাগল, 'না ভাই, না ভাই, এখন আমায় গাইতে বল না । সত্যি বলছি, আজকে আমার গলা তেমন খুলবে না ।' আমি বললাম, 'কি আপদ ! কে তোমায় গাইতে বলছে ?'
লোকটা এমন বেহায়া, সে তবুও আমার কানের কাছে ঘ্যান্ঘ্যান করতে লাগল, 'রাগ করলে ? হ্যাঁ ভাই, রাগ করলে ? আচ্ছা, না হয় কয়েকটা গান শুনিয়ে দিচ্ছি, রাগ করবার দরকার কি ভাই ?'
আমি কিছু বলবার আগেই ছাগলটা আর হিজিবিজ্বিজ্টা এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, 'হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, গান হোক গান হোক ।' অমনি নেড়াটা তার পকেট থেকে মস্ত দুই তাড়া গানের কাগজ বার করে, সেগুলো চোখের কাছে নিয়ে গুন্গুন্ করতে করতে হঠাৎ সরু গলায় চীৎকার করে গান ধরল- 'লাল গানে নীল সুর, হাসি-হাসি গন্ধ ।' ঐ একটিমাত্র পদ সে একবার গাইল, দুবার গাইল, পাঁচবার, দশবার গাইল ।
আমি বললাম, 'এতো ভারি উৎপাত দেখছি, গানের কি আর কোনো পদ নেই ?'
নেড়া বলল, 'হাঁ, আছে, কিন্তু সেটা অন্য একটা গান । সেটা হচ্ছে- অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুনকাম । সে গান আজকাল আমি গাই না । আরেকটা গান আছে- নাইনিতালের নতুন আলু- সেটা খুব নরল সুরে গাইতে হয় । সেটাও আজকাল গাইতে পারি না । আজকাল যেটা গাই, সেটা হচ্ছে শিখিপাখার গান ।' এই বলে সে গান ধরল-
মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে
শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে
আলোভোলা বাঁকা আলো আধো আধো কতদূরে
সরু মোটা শাদা কালো ছলছল ছায়াসুরে ।
আমি বললাম, 'এ আবার গান হল নাকি । এর তো মাথামুণ্ডু কোনো মানেই হয় না ।'
হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'হ্যাঁ, গানটা ভারি শক্ত ।'
ছাগল বলল, 'শক্ত আবার কোথায় ? ঐ শিশি বোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকল, তাছাড়া তো শক্ত কিছু পেলাম না ।'
নেড়াটা খুব অভিমান করে বলল, 'তা, তোমরা সহজ গান শুনতে চাও তো সে কথা বললেই হয় । অত কথা শোনাবার দরকার কি ? আমি কি আর সহজ গান গাইতে পারি না ?' এই বলে সে গান ধরল-
বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু ।
আমি বললাম, 'মজারু বলে কোনো কথা হয় না ।' নেড়া বলল, 'কেন হবে না- আলবৎ হয় । সজারু কাঙ্গারু দেবদারু সব হতে পারে, মজারু কেন হবে না ?'
ছাগল বলল, 'ততক্ষণ গানটা চলুক না, হয় কি না-হয় পরে দেখা যাবে ।' অমনি আবার গান শুরু হল-
বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু ।
আজকে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা
আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা ।
কাঁপবে ভয়ে ব্যাঙগুলো আর ব্যাঙাচি,
ঘামতে ঘামতে ফুটবে তাদের ঘামাচি,
ছুটবে ছুঁচো লাগবে দাঁতে কপাটি,
দেখবে তখন ছিম্বি ছ্যাঙা চপাটি ।
আমি আবার আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সামলে গেলাম । গান চলতে লাগল-
সজারু কয় ঝোপের মাঝে এখনি
গিন্নী আমার ঘুম দিয়েছেন দেখনি ?
জেনে রাখুন প্যাঁচা এবং প্যাঁচানী,
ভাঙলে সে ঘুম শুনে তাদের চ্যাঁচানি,
খ্যাংরা-খোঁচা করব তাদের খুঁচিয়ে-
এই কথাটা বলবে তাদের বুঝিয়ে ।
বাদুড় বলে, পেঁচার কুটুম কুটুমী
মানবে না কেউ তোমার এসব ঘুঁতুমি ।
ঘুমোয় কি কেউ এমন ভুসো আঁধারে ?
গিন্নী তোমার হোৎকা এবং হাঁদাড়ে ।
তুমিও দাদা হচ্ছ ক্রমে খ্যাপাটে
চিমনি-চাটা ভোঁপসা-মুখো ভ্যাঁপাটে ।
গানটা আরও চলত কিনা জানি না, কিন্তু এই পর্যন্ত হতেই একটা গোলমাল শোনা গেল । তাকিয়ে দেখি, আমার আশেপাশে চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে । একটা সজারু এগিয়ে এসে ফোঁৎফোৎ করে কাঁদছে আর একটা শাম্লাপরা কুমির মস্ত একটা বই দিয়ে আস্তে আস্তে তার পিঠ থাব্রাচ্ছে আর ফিস্ফিস্ করে বলছে, 'কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি ।' হঠাৎ একটা তকমা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা কোলা ব্যাং রুল উচিয়ে চীৎকার করে বলে উঠল- 'মানহানির মোকদ্দমা ।'
অমনি কোত্থেকে একটা কালো ঝোল্লা-পরা হুতোম প্যাঁচা এসে সকলের সামনে একটা উঁচু পাথরের উপর বসেই চোখ বুজে ঢুলতে লাগল, আর একটা মস্ত ছুঁচো একটা বিশ্রী নোংরা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করতে লাগল ।
প্যাঁচা একবার ঘোলা ঘোলা চোখ করে চারদিকে তাকিয়েই তক্ষনি আবার চোখ বুজে বলল, 'নালিশ বাতলাও ।'
বলতেই কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিম্চিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল । তারপর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, 'ধর্মাবতার হুজুর ! এটা মানহানির মোকদ্দমা । সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে মান কাকে বলে । মান মানে কচু । কচু অতি উপাদেয় জিনিস । কচু অনেক প্রকার, যথা- মানকচু, ওলকচু, কান্দাকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু ইত্যাদি । কচুগাছের মূলকে কচু বলে, সুতরাং বিষয়টা একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার ।'
এইটুকু বলতেই একটা শেয়াল শাম্লা মাথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, 'হুজুর, কচু অতি অসার জিনিস । কচু খেলে গলা কুট্কুট্ করে, কচুপোড়া খাও বললে মানুষে চটে যায় । কচু খায় কারা ? কচু খায় শুওর আর সজারু । ওয়াক থুঃ ।'
সজারুটা আবার ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমির সেই প্রকাণ্ড বই দিয়ে তার মাথায় এক থাব্ড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, 'দলিলপত্র সাক্ষী-সাবুদ কিছু আছে ?' সজারু ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, 'ঐ তো ওর হাতে সব দলিল রয়েছে ।' বলতেই কুমিরটা ন্যাড়ার কাছ থেকে একতাড়া গানের কাগজ কেড়ে নিয়ে হঠাৎ এক যায়গা থেকে পড়তে লাগল-
একের পিঠে দুই
চৌকি চেপে শুই
পোঁটলা বেঁধে থুই
গোলাপ চাঁপা জুঁই
ইলিশ মাগুর রুই
হিন্চে পালং পুঁই
সান্ বাঁধানো ভুঁই
গোবর জলে ধুই
কাঁদিস কেন তুই ?
সজারু বলল, 'আহা ওটা কেন ? ওটা তো নয় ।' কুমির বলল, 'তাই নাকি ? আচ্ছা, দাঁড়াও ।' এই বলে সে আবার একখানা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগল-
চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজ্ না রে-
থ্যাঁৎলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ্ ভোজ মারে ।
চাল্তা গাছে আল্তা পরা নাক ঝোলানো শাঁকচুনি
মাক্ড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেউ ডাঁকছনি !
মুণ্ডু ঝোলা উলটোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
বলছে দুলে, মিন্সেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে ।
সজারু বলল, 'দূর ছাই ! কি যে পড়ছে তার নেই ঠিক ।'
কুমির বলল, 'তাহলে কোন্টা, এইটা !- দই দম্বল, টেকো অম্বল, কাঁথা কম্বল করে সম্বল বোকা ভোম্বল- এটাও নয় ? আচ্ছা দাঁড়াও দেখছি- নিঝুম নিশুত রাতে, একা শুয়ে তেতলাতে, খালিখালি খিদে পায় কেন রে ?- কি বললে ? ওসব নয় ? তোমার গিন্নীর নামে কবিতা ?
-তা, সে কথাটা আগে বললেই হত । এই তো- রাম ভজনের গিন্নীটা, বাপরে, যেন সিংহীটা ! বাসন নাড়ে ঝনার্ঝন্, কাপড় কাচে দমদ্দম্- এটাও মিলছে না ? তা হলে নিশ্চয়ই এটা-
খুস্খুসে কাশি ঘুষ্ঘুষে জ্বর ফুস্ফুসে ছ্যাঁদা বুড়ো তুই মর্ ।
মাজ্রাতে ব্যাথা পাঁজরাতে বাত, আজ রাতে বুড়ো হবি কুপোকাৎ !
সজারুটা ভয়ানক কাঁদতে লাগল, 'হায়, হায় ! আমার পয়সাগুলো সব জলে গেল ! কোথাকার এক আহাম্মক উকিল, দলিল দিলে খুঁজে পায় না !'
ন্যাড়াটা এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, সে হঠাৎ বলে উঠল, 'কোনটা শুনতে চাও ? সেই যে- বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু- সেইটে?' সজারু ব্যস্ত হয়ে বলল, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, সেইটে, সেইটে ।'
অমনি শেয়াল আবার তেড়ে উঠল, 'বাদুড় কি বলে ? হুজুর, তাহলে বাদুড়গোপালকে সাক্ষী মানতে আজ্ঞা হোক ।' কোলা ব্যাঙ গলা ফুলিয়ে হেঁকে বলল, 'বাদুড়গোপাল হাজির ?'
সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কোত্থাও বাদুড় নেই । তখন শেয়াল বলল, 'তাহলে হুজুর, ওদের সক্কলের ফাঁসির হুকুম হোক ।' কুমির বলল, 'তা কেন ? আমরা এখন আপিল করব ।'
প্যাঁচা চোখ বুজে বলল, 'আপিল চলুক । সাক্ষী আনো ।'
কুমির এদিক ওদিক তাকিয়ে হিজিবিজ্বিজ্কে জিজ্ঞাসা করল, 'সাক্ষী দিবি ? চার আনা পয়সা পাবি ।' পয়সার নামে হিজিবিজ্বিজ্ তড়াক্ করে সাক্ষী দিতে উঠেই ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে হেসে ফেলল ।
শেয়াল বলল, 'হাসছ কেন ?' হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, বইটার সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া আর মাথার উপর লালকালির ছাপ । উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি আসামীকে চেন ? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া, মাথার উপর লালকালির ছাপ- হোঃ হোঃ হোঃ হো-'
শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি সজারুকে চেন ?' হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'হ্যাঁ, সজারু চিনি, কুমির চিনি, সব চিনি । সজারু গর্তে থাকে, আর গায়ে লম্বা কাঁটা, আর কুমিরের গায়ে চাকা চাকা ঢিপির মতো, তারা ছাগল-টাগল ধরে খায় ।' বলতেই ব্যাকরণ শিং ব্যা ব্যা করে ভয়ানক কেঁদে উঠল ।
আমি বললাম, 'আবার কি হল ?' ছাগল বলল, 'আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল ।' আমি বললাম, 'গেল তো গেল, আপদ গেল । তুমি এখন চুপ কর ।'
শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি মোকদ্দমার কিছু জান ?' হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'তা আর জানি নে ? একজন নালিশ করে, তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী, তারও একজন উকিল থাকে । এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে । আর একজন জজ থাকে, সে বসে বসে ঘুমোয় ।'
প্যাঁচা বলল, কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি ।'
হিজিবিজ্বিজ্ বলল, আরও অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম ।' বলেই সে ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল ।
শেয়াল বলল, 'আবার কি হল ?' হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত । তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, আর ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমুঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে । হোঃ হোঃ হোঃ হো-'
শেয়াল বলল, 'বটে ? তোমার নাম কি শুনি ?' সে বলল, 'এখন আমার নাম হিজিবিজ্বিজ্ ।'
শেয়াল বলল, 'নামের আবার এখন-তখন কি ? হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'তাও জানো না ? সকালে আমার নাম থাকে আলু-নারকোল, আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু ।'
শেয়াল বলল, 'নিবাস কোথায় ?' হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'কার কথা বলছ ? শ্রীনিবাস ? শ্রীনিবাস দেশে চলে গিয়েছে ।' অমনি ভিড়ের মধ্যে থেকে উদো আর বুধো একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, 'তাহলে শ্রীনিবাস নিশ্চয়ই মরে গিয়েছে ।' উদো বলল, 'দেশে গেলেই লোকেরা সব হুস্ হুস্ করে মরে যায় ।' বুধো বলল, 'হাবুলের কাক যেই দেশে গেল অমনি শুনি সে মরে গিয়েছে ।'
শেয়াল বলল, 'আঃ, সবাই মিলে কথা বোলো না, ভারি গোলমাল হয় ।' শুনে উদো বুধোকে বলল, 'ফের যদি সবাই মিলে কথা বলবি তো তোকে মারতে মারতে সাবাড় করে ফেলব ।' বুধো বলল, 'আবার যদি গোলমাল করিস তাহলে তোকে ধরে এক্কেবারে পোঁটলা-পেটা করে দেব ।'
শেয়াল বলল, 'হুজুর, এরা সব পাগল আর আহাম্মক, এদের সাক্ষীর কোনো মূল্য নেই ।' শুনে কুমির রেগে ল্যাজ আছড়িয়ে বলল, 'কে বলল মূল্য নেই ? দস্তুরমতো চার আনা পয়সা খরচ করে সাক্ষী দেওয়ানো হচ্ছে ।' বলেই সে তক্ষুনি ঠক্ঠক্ করে ষোলটা পয়সা গুণে হিজিবিজ্বিজের হাতে দিয়ে দিল । অমনি কে যেন উপর থেকে বলে উঠল '১নং সাক্ষী, নগদ হিসাব, মূল্য চার আনা ।' চেয়ে দেখলাম কাক্কেশ্বর বসে বসে হিসাব লিখছে ।
শেয়াল আবার জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি এ বিষয়ে আর কিছু জানো না ?' হিজিবিজ্বিজ্ খানিক ভেবে বলল, 'শেয়ালের বিষয়ে একটা গান আছে, সেইটা জানি ।'
শেয়াল বলল, 'কি গান শুনি ?' হিজিবিজ্বিজ্ সুর করে বলতে লাগল, 'আয়, আয়, আয়, শেয়ালে বেগুন খায়, তারা তেল আর নুন কোথায় পায়- বলতেই শেয়াল ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল, 'থাক্ থাক্, সে অন্য শেয়ালের কথা, তোমার সাক্ষী দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে ।'
এদিকে হয়েছে কি, সাক্ষীরা পয়সা পাচ্ছে দেখে সাক্ষী দেবার ভয়ানক হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে । সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করছে, এমন সময় হঠাৎ দেখি কাক্কেশ্বর ঝুপ্ করে গাছ থেকে নেমে এসে সাক্ষীর জায়গায় বসে সাক্ষী দিতে আরম্ভ করেছে । কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই সে বলতে আরম্ভ করল, 'শ্রীশ্রীভূশণ্ডিকাগায় নমঃ । শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে, ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি । আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা পাইকারী সকল প্রকার গণনার কার্য-'
শেয়াল বলল, 'বাজে কথা বল না, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও । কি নাম তোমার ?'
কাক বলল, 'কি আপদ ! তাই তো বলছিলাম- শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে ।' শেয়াল বলল, 'নিবাস কোথায় ?' কাক বলল, 'বললাম যে কাগেয়াপটি ।'
শেয়াল বলল, 'সে এখান থেকে কতদূর ?' কাক বলল, 'তা বলা ভারি শক্ত । ঘণ্টা হিসাবে চার আনা, মাইল হিসাবে দশ পয়সা, নগদ দিলে দু পয়সা কম । যোগ করলে দশ আনা, বিয়োগ করলে তিন আনা, ভাগ করলে সাত পয়সা, গুণ করলে একুশ টাকা ।'
শেয়াল বলল, 'আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না । জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ি যাবার পথটা চেন তো ?' কাক বলল, 'তা আর চিনিনে ? এইতো সামনেই সোজা পথ দেখা যাচ্ছে ।' শেয়াল বলল, 'এ-পথ কতদূর গিয়েছে ?' কাক বলল, পথ আবার যাবে কোথায় ? যেখানকার পথ সেখানেই আছে । পথ কি আবার এদিক ওদিক চলে বেড়ায় ? না দার্জিলিঙে হাওয়া খেতে যায় ?'
শেয়াল বলল, 'তুমি তো ভারি বেয়াদব হে ! বলি, সাক্ষী দিতে এসেছ, মোকদ্দমার কিছু কি জান ?'
কাক বলল, 'খুব যা হোক ! এতক্ষণ বসে বসে হিসাব করল কে ? যা কিছু জানতে চাও আমার কাছে পাবে । এই তো প্রথমেই, মান কাকে বলে ? মান মানে কচুরি । কচুরি চার প্রকার- হিঙে কচুরি, খাস্তা কচুরি, নিমকি কচুরি আর জিবেগজা ! খেলে কি হয় ? খেলে শেয়ালদের গলা কুট্কুট্ করে, কিন্তু কাগেদের করে না । তারপর একজন সাক্ষী ছিল, নগদ মূল্য চার আনা, সে আসামে থাকত, তার কানের চামড়া নীল হয়ে গেল- তাকে বলে কালাজ্বর । তারপর একজন লোক ছিল, সে সকলের নামকরণ করত- শেয়ালকে বলতো তেলচোরা, কুমিরকে বলতো অষ্টাবক্র, প্যাঁচাকে বলতো বিভীষণ-'
বলতেই বিচার সভায় একটা ভয়ানক গোলমাল বেধে গেল । কুমির হঠাৎ খেপে টপ্ করে কোলা ব্যাংকে খেয়ে ফেলল, তাই দেখে ছুঁচোটা কিচ্কিচ্ করে ভয়ানক চ্যাঁচাতে লাগল, শেয়াল একটা ছাতা দিয়ে হুস্ হুস্ করে কাক্কেশ্বরকে তাড়াতে লাগল । প্যাঁচা গম্ভীর হয়ে বলল, সবাই চুপ কর, আমি মোকদ্দমার রায় দেব ।' এই বলেই সে একটা কানে-কলম-দেওয়া খরগোশকে হুকুম করল, 'যা বলছি লিখে নাও, মানহানির মোকদ্দমা, ২৪ নম্বর ।
ফরিয়াদী- সজারু । আসামী- দাঁড়াও । আসামী কৈ ?' তখন সবাই বলল, ঐ যা ! আসামী তো কেঊ নেই ।' তাড়াতাড়ি ভুলিয়ে-ভালিয়ে ন্যাড়াকে আসামী দাঁড় করানো হল । ন্যাড়াটা বোকা, সে ভাবল আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না ।
হুকুম হল- ন্যাড়ার তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি । আমি সবে ভাবছি এরকম অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে আপত্তি করা উচিত, এমন সময় ছাগলটা হঠাৎ 'ব্যা-করণ শিং' বলে পিছন থেকে তেড়ে এসে আমায় ঢুঁ মারল, তারপরেই আমার কান কামড়ে দিল । অমনি চারদিকে কি রকম সব ঘুলিয়ে যেতে লাগল, ছাগলটার মুখটা ক্রমে বদলিয়ে শেষটায় ঠিক মেজোমামার মতো হয়ে গেল। তখন ঠাওর করে দেখলাম, মেজোমামা আমার কান ধরে বলছেন, 'ব্যাকরণ শিখবার নাম করে বুঝি পড়ে পড়ে ঘুমানো হচ্ছে ?'
আমি তো অবাক ! প্রথমে ভাবলাম বুঝি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম । কিন্তু, তোমরা বললে বিশ্বাস করবে না, আমার রুমালটা খুঁজতে গিয়ে দেখি কোথাও রুমাল নেই, আর একটা বেড়াল বেড়ার উপর বসে বসে গোঁফে তা দিচ্ছিল, হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়েই খচ্মচ্ করে নেমে পালিয়ে গেল । আর ঠিক সেই সময়ে বাগানের পিছন থেকে একটা ছাগল ব্যা করে ডেকে উঠল ।
আমি বড়মামার কাছে এসব কথা বলেছিলাম, কিন্তু বড়মামা বললেন, 'যা, যা, কতগুলো বাজে স্বপ্ন দেখে তাই নিয়ে গল্প করতে এসেছে ।' মানুষের বয়স হলে এমন হোঁৎকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না । তোমাদের কিনা এখনও বয়স বেশি হয়নি, তাই তোমাদের কাছে ভরসা করে এসব কথা বললাম ।
Sunday, 28 November 2010
দাশুর খ্যাপামি
ইস্কুলের ছুটির দিন । ইস্কুলের পরেই ছাত্র-সমিতির অধিবেশন হবে, তাতে ছেলেরা মিলে অভিনয় করবে । দাশুর ভারি ইচ্ছে ছিল, সে-ও একটা কিছু অভিনয় করে । একে-ওকে দিয়ে সে অনেক সুপারিশ করিয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই কোমর বেঁধে বললাম, সে কিছুতেই হবে না ।
সেইতো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল, তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল ; সেবার সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল । যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, "সাহস থাকিলে খোল তলোয়ার !" দাশুর তখন "তবে আয় সম্মুখ সমরে"- ব'লে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা । কিন্তু দাশুটা আনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতেই পারল না, মাঝ থেকে ঘাবরে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল । তাই দেখে গুপ্তচর আবার "খোল তলোয়ার" ব'লে হুঙ্কার দিয়ে উঠল । দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি "দাঁড়া, দেখছিস না বক্লস আটকিয়ে গেছে" ব'লে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল । ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ার খুলে দিলাম, তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত । তারপর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞেস করলেন, "কিবা চাহ পুরস্কার কহ সেনাপতি," তখন দাশুর বলবার কথা ছিল "নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি," কিন্তু দাশুটা তা না ব'লে, তার পরের আরেকটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে "ঐ যাঃ ! ভুলে গেছিলাম" ব'লে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল । আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল ।
তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে ব'লে উঠলাম, "না, সে কিছুতেই হবে না ।" বিশু বলল, "দাশু এক্টিং করবে ? তাহলেই চিত্তির !" ট্যাঁপা বলল, "তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয় !" দাশু বেচারা প্রথমে খুব মিনতি করল, তারপর চটে উঠল, তারপর কেমন যেন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল । যে কয়দিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমদের অভিনয় শুনত । ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছাত্র গণশার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গনশা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমচমৎকার আবৃত্তি করতে পারে-তাই তাকে দেবদূতের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে নানারকম খাওয়া এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণশার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোন কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না । কেবল দেখতে পেলাম, গণশা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে 'দাশুদা'র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল ।
ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল । আড়াইটা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে । আমরা জিজ্ঞেস করলাম, "কিরে ? তুই এখানে কি করছিস ?" দাশু বলল "বাঃ, পোশাক পরব না ?" আমি বললাম, "পোশাক পরবি কিরে? তুই তো আর এক্টিং করবি না ।" দাশু বলল, "বাঃ, খুব তো খবর রাখ । আজকে দেবদূত সাজবে কে জানো ?" শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, "কেন গণশার কি হল ?" দাশু বলল, কি হয়েছে তা গণশাকে জিজ্ঞেস করলেই পারো ?" তখন চেয়ে দেখি সবাই এসেছে, কেবল গণশাই আসেনি । অমনি রামপদ, বিশু আর আমি ছুটে বেরোলাম গণশার খোঁজে ।
সারা ইস্কুল খুঁজে, শেষটায় টিফিনঘরের পিছনে হতভাগাকে ঝুঁজে পাওয়া গেল । সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমরা তাকে চটপট গ্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম । গণশা কাঁদতে লাগল, "না আমি কক্ষনো এক্টিং করব না, তাহলে, দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না ।" আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত । তিনি আমাদের দেখেই ভয়ঙ্কর চোখ লাল করে ধমক দিয়ে উঠলেন, "তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পিছনে লেগেছিস ? তোদের লজ্জাও করে না ?" ব'লেই আমাকে বিশুকে এক একটি চড় মেরে আর রামপদর কান ম'লে দিয়ে হন্হন্ করে চলে গেলেন । এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গণেশ্চন্দ্র আবার চম্পট দিল । আমরাও আপমানটা হজম করে ফিরে এলাম । এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে । রাখাল বলছে, "তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না ।" দাশু বলছে, "বেশ তো, তাহলে আর কেউ সাজুক, আমি রাজা কিম্বা মন্ত্রী সাজি । পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্থ হয়ে আছে ।" এমন সময় আমরা এসে খবর দিলাম, যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না । তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঁটিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক । শুনে দাশু খুব খুশি হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, "আবার যদি তোরা গোলমাল করিস, তাহলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভুণ্ডুল করে দেব ।"
তারপর অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম দৃশ্যে দাশু কিছু গোলমাল করেনি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক্ ফেলেছিল । কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল । এক জায়গায় তার খালি বলবার কথা "দেবতা বিমুখ হলে মানুষ কি পারে ?" কিন্তু সে এক কথাটুকুর আগে কোত্থেকে আরও চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল ! আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, দাশু বলল, "তোমরা যে লম্বা বক্তৃতা কর সে বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ !" এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেই আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল । আমরা অনেক কষ্টে অনেক তোয়াজ করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে, দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন । শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, দেবদূত মহারাজাকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরীতে প্রস্থান করেছেন । দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয়নি ।
শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হবেন । এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, "বারবার মহারাজে আশিস্ করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে ।" বলতে বলতেই হঠাৎ কোত্থেকে "আবার সে এসেছে ফিরিয়া" ব'লে একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত । হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কি রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম- অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগার হয়ে এল । তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, "বলে যাও কি বলিতেছিলে ।" তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল । রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কি যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু "চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা"- বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল । ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা- "এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা" ইত্যাদি- নিজেই গড়গড় করে ব'লে গিয়ে, "যাও সবে নিজ নিজ কাজে" ব'লে অভিনয় শেষ করে দিল । আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ্ করে পর্দাও নেমে গেল ।
আমরা সব রেগে-মেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, "হতভাগা, দ্যাখ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথাই বলা হল না ।" দাশু বলল, বা, তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম । তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত ।" আমি বললাম, তুই কেন মাঝখানে এসে গোল বাধিয়ে দিলি ? তাইতো সব ঘুলিয়ে গেল ।" দাশু বলল, রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে আটকিয়ে রাখবে ? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোরা থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে ? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিল ?" রামপদ বলল, ওকে ধরে ঘা দু চার লাগিয়ে দে ।"
দাশু বলল, "লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কি না? "
সেইতো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল, তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল ; সেবার সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল । যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, "সাহস থাকিলে খোল তলোয়ার !" দাশুর তখন "তবে আয় সম্মুখ সমরে"- ব'লে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা । কিন্তু দাশুটা আনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতেই পারল না, মাঝ থেকে ঘাবরে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল । তাই দেখে গুপ্তচর আবার "খোল তলোয়ার" ব'লে হুঙ্কার দিয়ে উঠল । দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি "দাঁড়া, দেখছিস না বক্লস আটকিয়ে গেছে" ব'লে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল । ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ার খুলে দিলাম, তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত । তারপর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞেস করলেন, "কিবা চাহ পুরস্কার কহ সেনাপতি," তখন দাশুর বলবার কথা ছিল "নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি," কিন্তু দাশুটা তা না ব'লে, তার পরের আরেকটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে "ঐ যাঃ ! ভুলে গেছিলাম" ব'লে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল । আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল ।
তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে ব'লে উঠলাম, "না, সে কিছুতেই হবে না ।" বিশু বলল, "দাশু এক্টিং করবে ? তাহলেই চিত্তির !" ট্যাঁপা বলল, "তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয় !" দাশু বেচারা প্রথমে খুব মিনতি করল, তারপর চটে উঠল, তারপর কেমন যেন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল । যে কয়দিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমদের অভিনয় শুনত । ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছাত্র গণশার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গনশা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমচমৎকার আবৃত্তি করতে পারে-তাই তাকে দেবদূতের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে নানারকম খাওয়া এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণশার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোন কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না । কেবল দেখতে পেলাম, গণশা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে 'দাশুদা'র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল ।
ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল । আড়াইটা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে । আমরা জিজ্ঞেস করলাম, "কিরে ? তুই এখানে কি করছিস ?" দাশু বলল "বাঃ, পোশাক পরব না ?" আমি বললাম, "পোশাক পরবি কিরে? তুই তো আর এক্টিং করবি না ।" দাশু বলল, "বাঃ, খুব তো খবর রাখ । আজকে দেবদূত সাজবে কে জানো ?" শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, "কেন গণশার কি হল ?" দাশু বলল, কি হয়েছে তা গণশাকে জিজ্ঞেস করলেই পারো ?" তখন চেয়ে দেখি সবাই এসেছে, কেবল গণশাই আসেনি । অমনি রামপদ, বিশু আর আমি ছুটে বেরোলাম গণশার খোঁজে ।
সারা ইস্কুল খুঁজে, শেষটায় টিফিনঘরের পিছনে হতভাগাকে ঝুঁজে পাওয়া গেল । সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমরা তাকে চটপট গ্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম । গণশা কাঁদতে লাগল, "না আমি কক্ষনো এক্টিং করব না, তাহলে, দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না ।" আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত । তিনি আমাদের দেখেই ভয়ঙ্কর চোখ লাল করে ধমক দিয়ে উঠলেন, "তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পিছনে লেগেছিস ? তোদের লজ্জাও করে না ?" ব'লেই আমাকে বিশুকে এক একটি চড় মেরে আর রামপদর কান ম'লে দিয়ে হন্হন্ করে চলে গেলেন । এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গণেশ্চন্দ্র আবার চম্পট দিল । আমরাও আপমানটা হজম করে ফিরে এলাম । এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে । রাখাল বলছে, "তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না ।" দাশু বলছে, "বেশ তো, তাহলে আর কেউ সাজুক, আমি রাজা কিম্বা মন্ত্রী সাজি । পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্থ হয়ে আছে ।" এমন সময় আমরা এসে খবর দিলাম, যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না । তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঁটিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক । শুনে দাশু খুব খুশি হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, "আবার যদি তোরা গোলমাল করিস, তাহলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভুণ্ডুল করে দেব ।"
তারপর অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম দৃশ্যে দাশু কিছু গোলমাল করেনি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক্ ফেলেছিল । কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল । এক জায়গায় তার খালি বলবার কথা "দেবতা বিমুখ হলে মানুষ কি পারে ?" কিন্তু সে এক কথাটুকুর আগে কোত্থেকে আরও চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল ! আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, দাশু বলল, "তোমরা যে লম্বা বক্তৃতা কর সে বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ !" এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেই আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল । আমরা অনেক কষ্টে অনেক তোয়াজ করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে, দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন । শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, দেবদূত মহারাজাকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরীতে প্রস্থান করেছেন । দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয়নি ।
শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হবেন । এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, "বারবার মহারাজে আশিস্ করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে ।" বলতে বলতেই হঠাৎ কোত্থেকে "আবার সে এসেছে ফিরিয়া" ব'লে একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত । হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কি রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম- অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগার হয়ে এল । তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, "বলে যাও কি বলিতেছিলে ।" তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল । রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কি যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু "চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা"- বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল । ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা- "এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা" ইত্যাদি- নিজেই গড়গড় করে ব'লে গিয়ে, "যাও সবে নিজ নিজ কাজে" ব'লে অভিনয় শেষ করে দিল । আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ্ করে পর্দাও নেমে গেল ।
আমরা সব রেগে-মেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, "হতভাগা, দ্যাখ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথাই বলা হল না ।" দাশু বলল, বা, তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম । তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত ।" আমি বললাম, তুই কেন মাঝখানে এসে গোল বাধিয়ে দিলি ? তাইতো সব ঘুলিয়ে গেল ।" দাশু বলল, রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে আটকিয়ে রাখবে ? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোরা থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে ? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিল ?" রামপদ বলল, ওকে ধরে ঘা দু চার লাগিয়ে দে ।"
দাশু বলল, "লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কি না? "
দাশুর কীর্তি
নবীনচাঁদ স্কুলে এসেই বলল, কাল তাকে ডাকাতে ধরেছিল। শুনে স্কুলশুদ্ধ সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে আসল। ``ডাকাতে ধরেছিল? কি বলিস রে?" ডাকাত না তো কি? বিকেলবেলায় সে জ্যোতিলালের বাড়ি পড়তে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরবার সময়ে ডাকতেরা তাকে ধরে, তার মাথায় চাঁটি মেরে, তার নতুন কেনা শখের পিরানটিতে কাদাজলের পিচকিরি দিয়ে গেল। আর যাবার সময় বলে গেল, ``চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক্---নইলে দড়াম্ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।'' তাই সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার ধারে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল; এমন সময় তার বড়মামা এসে তার কান ধরে বাড়িতে নিয়ে বললেন, ``রাস্তায় সং সেজে এয়ার্কি করা হচ্ছিল?'' নবীনচাঁদ কাঁদ-কাঁদ গলায় বলে উঠল ``আমি কি করব? আমায় ডাকাত ধরেছিল---'' শুনে তার মামা প্রকাণ্ড এক চড় তুলে বললেন, ``ফের জ্যাঠামি!'' নবীনচাঁদ দেখল মামার সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা--- কারণ, সত্যিসত্যিই তাকে যে ডাকাতে ধরেছিল, এ কথা তার বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত! সুতরাং তার মনের দুঃখ এতক্ষণ মনের মধ্যেই চাপা ছিল। স্কুলে এসে আমাদের কাছে বসতে না বসতেই সে দুঃখ একেবারে উথলিয়ে উঠল।
যাহোক, স্কুলে এসে তার দুঃখ বোধ হয় অনেকটা দুর হতে পেরেছিল, কারণ, স্কুলের অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার ঘামাচি, ফুসকুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমান বলে স্বীকার করেছিল। দুয়েকজন, যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো বলে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাঁটুর কাছে যে ছড়ে গেছে সেটা একেবারে টাটকা নতুন। কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মত ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বলল, ``ওটা তো জুতোর ফোস্কা,'' তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বলল, ``যাও, তোমাদের কাছে আর কিচ্ছু বলব না!'' কেষ্টাটার জন্য আমাদের আর কিছুই শোনা হল না।
ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেলাম, এমন সময় দেখি পাগলা দাশু একগাল হাসি নিয়ে ক্লাশে ঢুকছে। আমরা বললাম, ``শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল।'' যেমন বলা, অমনি দাশরথি হঠাত্ হাত-পা ছেড়ে বইটই ফেলে খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের ওপর বসে পড়ল! পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিত হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না! দেখে আমরা তো অবাক! পণ্ডিতমশায় ক্লাসে এসেছেন, তখনো পুরোদমে তার হাসি চলেছে। সবাই ভাবল, ``ছোঁড়াটা খেপে গেল নাকি?'' যা হোক, খুব খানিকটা হুটোপুটির পর সে ঠান্ডা হয়ে, বইটই গুটিয়ে বেঞ্চের উপর উঠে বসল। পণ্ডিতমশায় বললেন, ``ওরকম হাসছিলে কেন?'' দাশু নবিনচাঁদকে দেখিয়ে বলল, ``ঐ ওকে দেখে।'' পণ্ডিতমশায় খুব কড়ারকমের ধমক লাগিয়ে তাকে ক্লাসের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। কিন্তু পাগলার তাতেও লজ্জা নেই, সে সারাটি ঘন্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিক্ফিক্ করে হাসতে লাগল।
টিফিনের ছুটির সময়ে নবু দাশুকে চেপে ধরল, ``কিরে দেশো! বড়ো যে হাসতে শিখেছিস!'' দাশু বলল, ``হাসব না? তুমি কাল ধুচুনি মাথায় দিয়ে কি রকম নাচটা নেচেছিলে, সে তো আর তুমি নিজে দেখনি? দেখলে বুঝতে কেমন মজা!'' আমরা সবাই বললাম, ``সে কি রকম? ধুচুনি মাথায় নচছিল মানে?'' দাশু বলল ``তাও জান না? ঐ কেষ্টা আর জগাই--- ঐ যা! বলতে বারণ করেছিল!'' আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ``কি বলছিস ভালো করেই বল-না।'' দাশু বলল, ``কালকে শেঠেদের বাগানের পেছন দিয়ে নবু একলা একলা বাড়ি যাচ্ছিল, এমন সময়ে দুটো ছেলে--- তাদের নাম বলতে বারণ--- তারা দৌড়ে এসে নবুর মাথায় ধুচুনির মতো কি একটা চাপিয়ে তার গায়ের উপর আচ্ছা করে পিচকিরি দিয়ে পালিয়ে গেল!'' নবু ভয়ানক দেগে বলল, ``তুই তখন কি করছিলি?'' দাশু বলল, ``তুমি তখন মাথার থলি খুলবার জন্য ব্যাঙের মতো হাত-পা ছুড়ে লাফাচ্ছিলে দেখে আমি বললাম, ফের নড়বি তো দড়াম্ করে মাথা উড়িয়ে দেব। তাই শুনে তুমি রাস্তার মধ্যে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, তাই আমি তোমার বড়োমামাকে ডেকে আনলাম।'' নবীনচাঁদের যেমন বাবুয়ানা, তেমনি তার দেমাক--- সেইজন্য কেউ তাকে পছন্দ করত না, তার লাঞ্ছনার বর্ণণা শুনে সবাই বেশ খুশি হলাম। ব্রজলাল ছেলেমানুষ, সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বলব, ``তবে যে নবীনদা বলছিল তাকে ডাকাতে ধরেছে?'' দাশু বলল, ``দূর বোকা! কেষ্টা কি ডাকাত?'' বলতে না বলতেই কেষ্টা সেখানে এসে হাজির। কেষ্টা আমাদের উপরের ক্লাসে পড়ে, তার গায়েও বেশ জোর আছে। নবীনচাঁদ তাকে দেখবামাত্র শিকারি বেড়ালের মতো ফুলে উঠল। কিন্তু মারামারি করতে সাহস পেল না, খানিকক্ষণ কট্মট্ করে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। আমরা ভাবলাম গোলমাল মিটে গেল!
কিন্তু তার পরদিন ছুটির সময় দেখি, নবীন তার দাদা মোহনচাঁদকে নিয়ে হন্হন্ করে আমাদের দিকে আসছে। মোহনচাঁদ এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়ে, সে আমাদের চাইতে অনেক বড়ো, তাকে ওরকমভাবে আসতে দেখেই আমরা বুঝলাম এবার একটা কাণ্ড হবে। মোহন এসেই বলল, ``কেষ্টা কই?'' কেষ্টা দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েই কোথায় সরে পড়েছে, তাই তাকে আর পাওয়া গেল না। তখন নবীনচাঁদ বলল ``ওই দাশুটা সব জানে, ওকে জিঞ্জেসা কর।'' মোহন বলল, ``কি হে ছোকরা তুমি সব জান নাকি?'' দাশু বলল, ``না, সব আর জানব কোত্থেকে--- এই তো সবে ফোর্থ ক্লাসে পড়ি, একটু ইংরিজি জানি, ভুগোল, বাংলা, জিওমেট্রি---'' মোহনচাঁদ ধমক দিয়ে বলল, ``সেদিন নবুকে যে কারা সব ঠেঙিয়েছিল, তুমি তার কিছু জান কি না?'' দাশু বলল, ঠ্যাঙায় নি তো--- মেরেছিল, খুব আস্তে মেরেছিল।'' মোহন একটুখানি ভেংচিয়ে বলল, ``খুব আস্তে মেরেছে, না? কতখানি আস্তে শুনি তো?'' দাশু বলল, ``সে কিছুই না--- ওরকম মারলে একটুও লাগে না।'' মোহন আবার ব্যঙ্গ করে বলল, ``তাই নাকি? কি রকম মারলে পরে লাগে?'' দাশু খানিকটা মাথা চুলকিয়ে তার পর বললে, ``ঐ সেবার হেডমাস্টার মশাই তোমায় যেমন বেত মেরেছিলেন সেইরকম!'' এই কথায় মোহন ভয়ানক চটে দাশুর কান মলে দিয়ে চীত্কার করে বলল, ``দ্যাখ বেয়াদব। ফের জ্যাঠামি করবি তো চাবকিয়ে লাল করে দেব। তুই সেখানে ছিলি কি না। আর কি রকম কি মেরেছিল সব খুলে বলবি কি না?''
জানই তো দাশুর মেজাজ কেমন পাগলাটেগোছের, সে একটুখানি কানে হাত বুলিয়ে তার পর মোহনচাঁদকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে বসল। কিল, ঘুঁষি, চড়, আঁচড়, কামড়, সে এমনি চটপট চালিয়ে গেল জে আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মোহন বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবে নি যে ফোর্থ ক্লাশের একটা রোগাছেলে তাকে অমনভাবে তেড়ে আসতে সাহস পাবে--- তাই সে একেবারে থতমত খেয়ে কেমন যেন লড়তেই পারল না। দাশু তাকে পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে মাটিতে চিতপাত্ করে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ``এর চাইতেও ঢের আস্তে মেরেছিল।'' এনট্রান্স ক্লাশের কয়েকটি ছেলে সেখানে দাড়িয়েছিল। তারা যদি মোহনকে সামলে না ফেলত, তা হলে সেদিন তার হাত থেকে দাশুকে বাঁচানোই মুস্কিল হত।
পরে একদিন কেষ্টাকে জিঞ্জেস করা হয়েছিল, ``হাঁ রে, নবুকে সেদিন তোরা অমন করলি কেন?'' কেষ্টা বলল, ``ঐ দাশুটাই তো শিখিয়েছিল ওরকম করতে। আর বলেছিল, `তা হলে এক সের জিলিপি পাবি'!'' আমরা বললাম, ``কই, আমাদের তো ভাগ দিলি নে?'' কেষ্টা বলল, ``সে কথা আর বলিস কেন? জিলিপি চাইতে গেলুম, হতভাগা বলে কিনা `আমার কাছে কেন? ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি'।''
আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচ্কেমি করে?
যাহোক, স্কুলে এসে তার দুঃখ বোধ হয় অনেকটা দুর হতে পেরেছিল, কারণ, স্কুলের অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার ঘামাচি, ফুসকুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমান বলে স্বীকার করেছিল। দুয়েকজন, যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো বলে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাঁটুর কাছে যে ছড়ে গেছে সেটা একেবারে টাটকা নতুন। কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মত ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বলল, ``ওটা তো জুতোর ফোস্কা,'' তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বলল, ``যাও, তোমাদের কাছে আর কিচ্ছু বলব না!'' কেষ্টাটার জন্য আমাদের আর কিছুই শোনা হল না।
ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেলাম, এমন সময় দেখি পাগলা দাশু একগাল হাসি নিয়ে ক্লাশে ঢুকছে। আমরা বললাম, ``শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল।'' যেমন বলা, অমনি দাশরথি হঠাত্ হাত-পা ছেড়ে বইটই ফেলে খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের ওপর বসে পড়ল! পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিত হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না! দেখে আমরা তো অবাক! পণ্ডিতমশায় ক্লাসে এসেছেন, তখনো পুরোদমে তার হাসি চলেছে। সবাই ভাবল, ``ছোঁড়াটা খেপে গেল নাকি?'' যা হোক, খুব খানিকটা হুটোপুটির পর সে ঠান্ডা হয়ে, বইটই গুটিয়ে বেঞ্চের উপর উঠে বসল। পণ্ডিতমশায় বললেন, ``ওরকম হাসছিলে কেন?'' দাশু নবিনচাঁদকে দেখিয়ে বলল, ``ঐ ওকে দেখে।'' পণ্ডিতমশায় খুব কড়ারকমের ধমক লাগিয়ে তাকে ক্লাসের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। কিন্তু পাগলার তাতেও লজ্জা নেই, সে সারাটি ঘন্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিক্ফিক্ করে হাসতে লাগল।
টিফিনের ছুটির সময়ে নবু দাশুকে চেপে ধরল, ``কিরে দেশো! বড়ো যে হাসতে শিখেছিস!'' দাশু বলল, ``হাসব না? তুমি কাল ধুচুনি মাথায় দিয়ে কি রকম নাচটা নেচেছিলে, সে তো আর তুমি নিজে দেখনি? দেখলে বুঝতে কেমন মজা!'' আমরা সবাই বললাম, ``সে কি রকম? ধুচুনি মাথায় নচছিল মানে?'' দাশু বলল ``তাও জান না? ঐ কেষ্টা আর জগাই--- ঐ যা! বলতে বারণ করেছিল!'' আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ``কি বলছিস ভালো করেই বল-না।'' দাশু বলল, ``কালকে শেঠেদের বাগানের পেছন দিয়ে নবু একলা একলা বাড়ি যাচ্ছিল, এমন সময়ে দুটো ছেলে--- তাদের নাম বলতে বারণ--- তারা দৌড়ে এসে নবুর মাথায় ধুচুনির মতো কি একটা চাপিয়ে তার গায়ের উপর আচ্ছা করে পিচকিরি দিয়ে পালিয়ে গেল!'' নবু ভয়ানক দেগে বলল, ``তুই তখন কি করছিলি?'' দাশু বলল, ``তুমি তখন মাথার থলি খুলবার জন্য ব্যাঙের মতো হাত-পা ছুড়ে লাফাচ্ছিলে দেখে আমি বললাম, ফের নড়বি তো দড়াম্ করে মাথা উড়িয়ে দেব। তাই শুনে তুমি রাস্তার মধ্যে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, তাই আমি তোমার বড়োমামাকে ডেকে আনলাম।'' নবীনচাঁদের যেমন বাবুয়ানা, তেমনি তার দেমাক--- সেইজন্য কেউ তাকে পছন্দ করত না, তার লাঞ্ছনার বর্ণণা শুনে সবাই বেশ খুশি হলাম। ব্রজলাল ছেলেমানুষ, সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বলব, ``তবে যে নবীনদা বলছিল তাকে ডাকাতে ধরেছে?'' দাশু বলল, ``দূর বোকা! কেষ্টা কি ডাকাত?'' বলতে না বলতেই কেষ্টা সেখানে এসে হাজির। কেষ্টা আমাদের উপরের ক্লাসে পড়ে, তার গায়েও বেশ জোর আছে। নবীনচাঁদ তাকে দেখবামাত্র শিকারি বেড়ালের মতো ফুলে উঠল। কিন্তু মারামারি করতে সাহস পেল না, খানিকক্ষণ কট্মট্ করে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। আমরা ভাবলাম গোলমাল মিটে গেল!
কিন্তু তার পরদিন ছুটির সময় দেখি, নবীন তার দাদা মোহনচাঁদকে নিয়ে হন্হন্ করে আমাদের দিকে আসছে। মোহনচাঁদ এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়ে, সে আমাদের চাইতে অনেক বড়ো, তাকে ওরকমভাবে আসতে দেখেই আমরা বুঝলাম এবার একটা কাণ্ড হবে। মোহন এসেই বলল, ``কেষ্টা কই?'' কেষ্টা দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েই কোথায় সরে পড়েছে, তাই তাকে আর পাওয়া গেল না। তখন নবীনচাঁদ বলল ``ওই দাশুটা সব জানে, ওকে জিঞ্জেসা কর।'' মোহন বলল, ``কি হে ছোকরা তুমি সব জান নাকি?'' দাশু বলল, ``না, সব আর জানব কোত্থেকে--- এই তো সবে ফোর্থ ক্লাসে পড়ি, একটু ইংরিজি জানি, ভুগোল, বাংলা, জিওমেট্রি---'' মোহনচাঁদ ধমক দিয়ে বলল, ``সেদিন নবুকে যে কারা সব ঠেঙিয়েছিল, তুমি তার কিছু জান কি না?'' দাশু বলল, ঠ্যাঙায় নি তো--- মেরেছিল, খুব আস্তে মেরেছিল।'' মোহন একটুখানি ভেংচিয়ে বলল, ``খুব আস্তে মেরেছে, না? কতখানি আস্তে শুনি তো?'' দাশু বলল, ``সে কিছুই না--- ওরকম মারলে একটুও লাগে না।'' মোহন আবার ব্যঙ্গ করে বলল, ``তাই নাকি? কি রকম মারলে পরে লাগে?'' দাশু খানিকটা মাথা চুলকিয়ে তার পর বললে, ``ঐ সেবার হেডমাস্টার মশাই তোমায় যেমন বেত মেরেছিলেন সেইরকম!'' এই কথায় মোহন ভয়ানক চটে দাশুর কান মলে দিয়ে চীত্কার করে বলল, ``দ্যাখ বেয়াদব। ফের জ্যাঠামি করবি তো চাবকিয়ে লাল করে দেব। তুই সেখানে ছিলি কি না। আর কি রকম কি মেরেছিল সব খুলে বলবি কি না?''
জানই তো দাশুর মেজাজ কেমন পাগলাটেগোছের, সে একটুখানি কানে হাত বুলিয়ে তার পর মোহনচাঁদকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে বসল। কিল, ঘুঁষি, চড়, আঁচড়, কামড়, সে এমনি চটপট চালিয়ে গেল জে আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মোহন বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবে নি যে ফোর্থ ক্লাশের একটা রোগাছেলে তাকে অমনভাবে তেড়ে আসতে সাহস পাবে--- তাই সে একেবারে থতমত খেয়ে কেমন যেন লড়তেই পারল না। দাশু তাকে পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে মাটিতে চিতপাত্ করে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ``এর চাইতেও ঢের আস্তে মেরেছিল।'' এনট্রান্স ক্লাশের কয়েকটি ছেলে সেখানে দাড়িয়েছিল। তারা যদি মোহনকে সামলে না ফেলত, তা হলে সেদিন তার হাত থেকে দাশুকে বাঁচানোই মুস্কিল হত।
পরে একদিন কেষ্টাকে জিঞ্জেস করা হয়েছিল, ``হাঁ রে, নবুকে সেদিন তোরা অমন করলি কেন?'' কেষ্টা বলল, ``ঐ দাশুটাই তো শিখিয়েছিল ওরকম করতে। আর বলেছিল, `তা হলে এক সের জিলিপি পাবি'!'' আমরা বললাম, ``কই, আমাদের তো ভাগ দিলি নে?'' কেষ্টা বলল, ``সে কথা আর বলিস কেন? জিলিপি চাইতে গেলুম, হতভাগা বলে কিনা `আমার কাছে কেন? ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি'।''
আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচ্কেমি করে?
Tuesday, 2 November 2010
দ্রিঘাংচু
এক ছিল রাজা।
রাজা একদিন সভায় বসেছেন--- চারিদিকে তাঁর পাত্র-মিত্র আমির ওমরা সিপাই শান্ত্রী গিজ গিজ করছে--- এমন সময় কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক উড়ে এসে সিংহাসনের ডান দিকে উঁচু থামের ওপর বসে ঘাড় নিচু ক'রে চারিদিক তাকিয়ে, অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ``কঃ''।
কথা নেই বার্তা নেই হঠাত্ এরকম গম্ভীর শব্দ--- সভাসুদ্ধ সকলের চোখ এক সঙ্গে গোল হয়ে উঠল--- সকলে একেবারে এক সঙ্গে হাঁ করে রইল। মন্ত্রী এক তাড়া কাগজ নিয়ে কি যেন বোঝাতে যাচ্ছিলেন, হঠাত্ বক্তৃতার খেই হারিয়ে তিনি বোকার মত তাকিয়ে রইলেন। দরজার কাছে একটা ছেলে বসে ছিল, সে হঠাত্ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, যে লোকটা চামর দোলাচ্ছিল, চামরটা তার হাত থেকে ঠাঁই করে রাজার মাথার ওপর পড়ে গেল। রাজামশায়ের চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছিল, তিনি হঠাত্ জেগে উঠেই বললেন, ``জল্লাদ ডাক।''
বলতেই জল্লাদ এসে হাজির। রাজামশাই বললেন, ``মাথা কেটে ফেল।'' সর্বনাশ! কার মাথা কাটতে বলে; সকলে ভয়ে ভয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। রাজামশাই খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে আবার তাকিয়ে বললেন, ``কই, মাথা কই?'' জল্লাদ বেচারা হাত জোড় করে বলল, ``আজ্ঞে মহারাজ, কার মাথা?'' রাজা বললেন, ``বেটা গোমুখ্যু কোথাকার, কার মাথা কিরে! যে ঐরকম বিটকেল শব্দ করেছিল, তার মাথা।'' শুনে সভাসুদ্ধ সকলে হাঁফ ছেড়ে এমন ভয়ানক নিশ্বাস ফেলল যে, কাকটা হঠাত্ ধড়ফড় করে সেখান থেকে উড়ে পালাল।
তখন মন্ত্রীমশাই রাজাকে বুঝিয়ে বললেন যে, ঐ কাকটাই ওরকম আওয়াজ করেছিল! তখন রাজামশাই বললেন, ``ডাকো পণ্ডিত সভার যত পণ্ডিত সবাইকে।'' হুকুম হওয়া মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজ্যের যত পণ্ডিত সব সভায় এসে হাজির। তখন রাজামশাই পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করলেন, ``এই যে একটা কাক এসে আমার সভার মধ্যে আওয়াজ করে এমন গোল বাধিয়ে গেল, এর কারণ কিছু বলতে পার?''
কাকে আওয়াজ করল তার আবার কারণ কি? পণ্ডিতেরা সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। একজন ছোকরা মতো পণ্ডিত খানিকক্ষণ কাঁচুমাচু ক'রে জবাব দিল, ``আজ্ঞে, বোধ হয় তার খিদে পেয়েছিল।'' রাজামশাই বললেন, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! খিদে পেয়েছিল, তা সভার মধ্যে আসতে যাবে কেন? এখানে কি মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হয়! মন্ত্রী ওকে বিদেয় করে দাও---'' সকলে মহা তম্বি ক'রে বললে, ``হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ওকে বিদায় করুন।''
আর-একজন পণ্ডিত বললেন, ``মহারাজ, কার্য থাকলেই তার কারণ আছে--- বৃষ্টি হলেই বুঝবে মেঘ আছে, আলো দেখলেই বুঝবে প্রদীপ আছে, সুতরাং বায়স পক্ষীর কণ্ঠ নির্গত এই অপরূপ ধ্বনিরূপ কার্যের নিশ্চয়ই কোন কারণ থাকবে, এতে আশ্চর্য কি?''
রাজা বললেন, ``আশ্চর্য এই যে, তোমার মতো মোটা বুদ্ধি লোকেও এইরকম আবোল তাবোল বকে মোটা মোটা মাইনে পাও। মন্ত্রী, আজ থেকে এঁর মাইনে বন্ধ কর।'' অমনি সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ``মাইনে বন্ধ কর।''
দুই পণ্ডিতের এরকম দুর্দশা দেখে সবাই কেমন ঘাবড়ে গেল। মিনিটের পর মিনিট যায়, কেউ আর কথা কয় না। তখন রাজামশাই দস্তুরমত খেপে গেলেন। তিনি হুকুম দিলেন, এর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন সভা ছেড়ে না ওঠে। রাজার হুকুম--- সকলে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ ঘেমে ঝোল হয়ে উঠল, চুলকে চুলকে কারো কারো মাথায় প্রকাণ্ড টাক পড়ে গেল। বসে বসে সকলের খিদে বাড়তে লাগল--- রাজামশাইয়ের খিদেও নেই, বিশ্রামও নেই--- তিনি বসে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
সকলে যখন হতাশ হয়ে এসেছে, আর মনে মনে পণ্ডিতদের `মূর্খ অপদার্থ নিষ্কর্মা' বলে গাল দিচ্ছে, এমন সময় রোগা শুঁটকো মতো একজন লোক হঠাত্ বিকট চিত্কার করে সভার মাঝখানে পড়ে গেল। রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র উজির-নাজির সবাই ব্যস্ত হয়ে বললেন, ``কি হলো, কি হলো?'' তখন অনেক জলের ছিটে পাখার বাতাস আর বলা কওয়ার পর লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বলল, ``মহারাজ সেটা কি দাঁড়কাক ছিল?'' সকলে বলল, ``হাঁ-হাঁ-হাঁ, কেন বল দেখি?'' লোকটা আবার বলল, ``মহারাজ, সে কি ঐ মাথার উপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসেছিল--- আর মাথা নিচু করেছিল, আর চোখ পাকিয়েছিল, আর `কঃ' করে শব্দ করেছিল?'' সকলে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললে, ``হাঁ, হাঁ--- ঠিক ঐরকম হয়েছিল।'' তাই শুনে লোকটা আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল--- আর বলতে লাগল, ``হায় হায়, সেই সময়ে কেউ আমায় খবর দিলে না কেন?''
রাজা বললেন, ``তাই তো, একে তোমরা তখন খবর দাও নি কেন?'' লোকটাকে কেউই চেনে না, তবু সে কথা বলতে সাহস পেল না, সবাই বললে, ``হ্যাঁ, ওকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল''--- যদিও কেন তাকে খবর দেবে, আর কি খবর দেবে, এ কথা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটা তখন খুব খানিকটা কেঁদে তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, ``দ্রিঘাংচু!'' সে আবার কি! সবাই ভাবল, লোকটা খেপে গেছে।
মন্ত্রী বললেন, ``দ্রিঘাঞ্চু কি হে?'' লোকটা বলল, ``দ্রিঘাঞ্চু নয়, দ্রিঘাংচু।'' কেউ কিছু বুঝতে পারল না--- তবু সবাই মাথা নেড়ে বলল, ``ও!'' তখন রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ``সে কিরকম হে,'' লোকটা বলল, ``আজ্ঞে আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি অত খবর রাখি, ছেলেবেলা থেকে দ্রিঘাংচু শুনে আসছি, তাই জানি দ্রিঘাংচু যখন রাজার সামনে আসে, তখন তাকে দেখতে দেখায় দাঁড়কাকের মতো। সে যখন সভায় ঢোকে, তখন সিংহাসনের ডান দিকের থামের উপর বসে মাথা নিচু করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে, চোখ পাকিয়ে `কঃ' বলে শব্দ করে। আমি তো আর কিছুই জানি না--- তবে পণ্ডিতেরা যদি জানেন।'' পণ্ডিতেরা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ``না, না, ওর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় নি।''
রাজা বললেন, ``তোমায় খবর দেয় নি ব'লে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কি?'' লোকটা বলল, ``মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।''
রাজা বললেন, ``যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে--- তুমি নির্ভয়ে বলে ফেল।'' সভাসুদ্ধ লোক তাতে হাঁ হাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।
লোকটা তখন বলল, ``মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম তা হলে কি যে আশ্চর্য কাণ্ড হত তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোন বইয়ে লেখে নি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব?'' রাজা বললেন, ``মন্ত্রটা আমায় বল তো।'' লোকটা বলল, ``সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারুর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি--- আপনি দুদিন উপোস ক'রে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে, তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে--- কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!''
তখন সভা ভঙ্গ হল। সভার সকলে এতক্ষণ হাঁ ক'রে শুনছিল, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; সকলে দ্রিঘাংচুর কথা, মন্ত্রের কথা আর আশ্চর্য ফল পাওয়ার কথা বলা-বলি করতে করতে বাড়ি চলে গেল।
তারপর রাজামশাই দু'দিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালবেলা--- সেই লোকটার লেখা কাগজখানা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে---
``হল্দে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাট্কেল চিত্ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।''
রাজামশাই গম্ভীরভাবে এটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন সব তাড়িয়ে তাকে মন্ত্র শোনাতেন, আর চেয়ে দেখতেন কোনরকম আশ্চর্য কিছু হয় কি না! কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি দ্রিঘাংচুর কোনো সন্ধান পান নি।
রাজা একদিন সভায় বসেছেন--- চারিদিকে তাঁর পাত্র-মিত্র আমির ওমরা সিপাই শান্ত্রী গিজ গিজ করছে--- এমন সময় কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক উড়ে এসে সিংহাসনের ডান দিকে উঁচু থামের ওপর বসে ঘাড় নিচু ক'রে চারিদিক তাকিয়ে, অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ``কঃ''।
কথা নেই বার্তা নেই হঠাত্ এরকম গম্ভীর শব্দ--- সভাসুদ্ধ সকলের চোখ এক সঙ্গে গোল হয়ে উঠল--- সকলে একেবারে এক সঙ্গে হাঁ করে রইল। মন্ত্রী এক তাড়া কাগজ নিয়ে কি যেন বোঝাতে যাচ্ছিলেন, হঠাত্ বক্তৃতার খেই হারিয়ে তিনি বোকার মত তাকিয়ে রইলেন। দরজার কাছে একটা ছেলে বসে ছিল, সে হঠাত্ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, যে লোকটা চামর দোলাচ্ছিল, চামরটা তার হাত থেকে ঠাঁই করে রাজার মাথার ওপর পড়ে গেল। রাজামশায়ের চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছিল, তিনি হঠাত্ জেগে উঠেই বললেন, ``জল্লাদ ডাক।''
বলতেই জল্লাদ এসে হাজির। রাজামশাই বললেন, ``মাথা কেটে ফেল।'' সর্বনাশ! কার মাথা কাটতে বলে; সকলে ভয়ে ভয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। রাজামশাই খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে আবার তাকিয়ে বললেন, ``কই, মাথা কই?'' জল্লাদ বেচারা হাত জোড় করে বলল, ``আজ্ঞে মহারাজ, কার মাথা?'' রাজা বললেন, ``বেটা গোমুখ্যু কোথাকার, কার মাথা কিরে! যে ঐরকম বিটকেল শব্দ করেছিল, তার মাথা।'' শুনে সভাসুদ্ধ সকলে হাঁফ ছেড়ে এমন ভয়ানক নিশ্বাস ফেলল যে, কাকটা হঠাত্ ধড়ফড় করে সেখান থেকে উড়ে পালাল।
তখন মন্ত্রীমশাই রাজাকে বুঝিয়ে বললেন যে, ঐ কাকটাই ওরকম আওয়াজ করেছিল! তখন রাজামশাই বললেন, ``ডাকো পণ্ডিত সভার যত পণ্ডিত সবাইকে।'' হুকুম হওয়া মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজ্যের যত পণ্ডিত সব সভায় এসে হাজির। তখন রাজামশাই পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করলেন, ``এই যে একটা কাক এসে আমার সভার মধ্যে আওয়াজ করে এমন গোল বাধিয়ে গেল, এর কারণ কিছু বলতে পার?''
কাকে আওয়াজ করল তার আবার কারণ কি? পণ্ডিতেরা সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। একজন ছোকরা মতো পণ্ডিত খানিকক্ষণ কাঁচুমাচু ক'রে জবাব দিল, ``আজ্ঞে, বোধ হয় তার খিদে পেয়েছিল।'' রাজামশাই বললেন, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! খিদে পেয়েছিল, তা সভার মধ্যে আসতে যাবে কেন? এখানে কি মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হয়! মন্ত্রী ওকে বিদেয় করে দাও---'' সকলে মহা তম্বি ক'রে বললে, ``হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ওকে বিদায় করুন।''
আর-একজন পণ্ডিত বললেন, ``মহারাজ, কার্য থাকলেই তার কারণ আছে--- বৃষ্টি হলেই বুঝবে মেঘ আছে, আলো দেখলেই বুঝবে প্রদীপ আছে, সুতরাং বায়স পক্ষীর কণ্ঠ নির্গত এই অপরূপ ধ্বনিরূপ কার্যের নিশ্চয়ই কোন কারণ থাকবে, এতে আশ্চর্য কি?''
রাজা বললেন, ``আশ্চর্য এই যে, তোমার মতো মোটা বুদ্ধি লোকেও এইরকম আবোল তাবোল বকে মোটা মোটা মাইনে পাও। মন্ত্রী, আজ থেকে এঁর মাইনে বন্ধ কর।'' অমনি সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ``মাইনে বন্ধ কর।''
দুই পণ্ডিতের এরকম দুর্দশা দেখে সবাই কেমন ঘাবড়ে গেল। মিনিটের পর মিনিট যায়, কেউ আর কথা কয় না। তখন রাজামশাই দস্তুরমত খেপে গেলেন। তিনি হুকুম দিলেন, এর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন সভা ছেড়ে না ওঠে। রাজার হুকুম--- সকলে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ ঘেমে ঝোল হয়ে উঠল, চুলকে চুলকে কারো কারো মাথায় প্রকাণ্ড টাক পড়ে গেল। বসে বসে সকলের খিদে বাড়তে লাগল--- রাজামশাইয়ের খিদেও নেই, বিশ্রামও নেই--- তিনি বসে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
সকলে যখন হতাশ হয়ে এসেছে, আর মনে মনে পণ্ডিতদের `মূর্খ অপদার্থ নিষ্কর্মা' বলে গাল দিচ্ছে, এমন সময় রোগা শুঁটকো মতো একজন লোক হঠাত্ বিকট চিত্কার করে সভার মাঝখানে পড়ে গেল। রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র উজির-নাজির সবাই ব্যস্ত হয়ে বললেন, ``কি হলো, কি হলো?'' তখন অনেক জলের ছিটে পাখার বাতাস আর বলা কওয়ার পর লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বলল, ``মহারাজ সেটা কি দাঁড়কাক ছিল?'' সকলে বলল, ``হাঁ-হাঁ-হাঁ, কেন বল দেখি?'' লোকটা আবার বলল, ``মহারাজ, সে কি ঐ মাথার উপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসেছিল--- আর মাথা নিচু করেছিল, আর চোখ পাকিয়েছিল, আর `কঃ' করে শব্দ করেছিল?'' সকলে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললে, ``হাঁ, হাঁ--- ঠিক ঐরকম হয়েছিল।'' তাই শুনে লোকটা আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল--- আর বলতে লাগল, ``হায় হায়, সেই সময়ে কেউ আমায় খবর দিলে না কেন?''
রাজা বললেন, ``তাই তো, একে তোমরা তখন খবর দাও নি কেন?'' লোকটাকে কেউই চেনে না, তবু সে কথা বলতে সাহস পেল না, সবাই বললে, ``হ্যাঁ, ওকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল''--- যদিও কেন তাকে খবর দেবে, আর কি খবর দেবে, এ কথা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটা তখন খুব খানিকটা কেঁদে তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, ``দ্রিঘাংচু!'' সে আবার কি! সবাই ভাবল, লোকটা খেপে গেছে।
মন্ত্রী বললেন, ``দ্রিঘাঞ্চু কি হে?'' লোকটা বলল, ``দ্রিঘাঞ্চু নয়, দ্রিঘাংচু।'' কেউ কিছু বুঝতে পারল না--- তবু সবাই মাথা নেড়ে বলল, ``ও!'' তখন রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ``সে কিরকম হে,'' লোকটা বলল, ``আজ্ঞে আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি অত খবর রাখি, ছেলেবেলা থেকে দ্রিঘাংচু শুনে আসছি, তাই জানি দ্রিঘাংচু যখন রাজার সামনে আসে, তখন তাকে দেখতে দেখায় দাঁড়কাকের মতো। সে যখন সভায় ঢোকে, তখন সিংহাসনের ডান দিকের থামের উপর বসে মাথা নিচু করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে, চোখ পাকিয়ে `কঃ' বলে শব্দ করে। আমি তো আর কিছুই জানি না--- তবে পণ্ডিতেরা যদি জানেন।'' পণ্ডিতেরা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ``না, না, ওর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় নি।''
রাজা বললেন, ``তোমায় খবর দেয় নি ব'লে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কি?'' লোকটা বলল, ``মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।''
রাজা বললেন, ``যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে--- তুমি নির্ভয়ে বলে ফেল।'' সভাসুদ্ধ লোক তাতে হাঁ হাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।
লোকটা তখন বলল, ``মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম তা হলে কি যে আশ্চর্য কাণ্ড হত তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোন বইয়ে লেখে নি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব?'' রাজা বললেন, ``মন্ত্রটা আমায় বল তো।'' লোকটা বলল, ``সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারুর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি--- আপনি দুদিন উপোস ক'রে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে, তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে--- কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!''
তখন সভা ভঙ্গ হল। সভার সকলে এতক্ষণ হাঁ ক'রে শুনছিল, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; সকলে দ্রিঘাংচুর কথা, মন্ত্রের কথা আর আশ্চর্য ফল পাওয়ার কথা বলা-বলি করতে করতে বাড়ি চলে গেল।
তারপর রাজামশাই দু'দিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালবেলা--- সেই লোকটার লেখা কাগজখানা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে---
``হল্দে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাট্কেল চিত্ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।''
রাজামশাই গম্ভীরভাবে এটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন সব তাড়িয়ে তাকে মন্ত্র শোনাতেন, আর চেয়ে দেখতেন কোনরকম আশ্চর্য কিছু হয় কি না! কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি দ্রিঘাংচুর কোনো সন্ধান পান নি।
Monday, 1 November 2010
বাজে গল্প ২
কতগুলো ছেলে ছাতের উপর হুড়োহুড়ি করে খেলা করছে-এমন সময়ে একটা মারামারির শব্দ শোনা গেল। তার পরেই হঠাৎ গোলমাল থেমে গিয়ে সবাই মিলে ‘হারু পড়ে গেছে’ বলে কাঁদতে কাঁদতে নিচে চলল।
খানিক বাদেই শুনি একতলা থেকে কান্নাকাটির শব্দ উঠছে। বাইরের ঘরে যদুর বাবা গণেশবাবু ছিলেন-তিনি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’ শুনতে পেলেন ছেলেরা কাঁদছে, ‘হারু পড়ে গিয়েছে।’ বাবু তখন দৌড়ে গেলেন ডাক্তার ডাকতে।
পাঁচ মিনিটে ডাক্তার এসে হাজির, কিন্তু হারু কোথায়? বাবু বললেন, ‘এদিকে তো পড়েনি, ভেতর বাড়িতে পড়েছে বোধহয়।’ কিন্তু ভেতর বাড়িতে মেয়েরা বললেন, ‘এখানে তো পড়েনি-আমরা তো ভাবছি বার-বাড়িতে পড়েছে বুঝি।’ বাইরেও নেই, ভেতরেও নেই, তবে কি ছেলে উড়ে গেল? তখন ছেলেদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোথায় রে? কোথায় হারু?’ তারা বললে, ‘ছাতের উপর।’ সেখানে গিয়ে তারা দেখে, হারু বাবু অভিমান করে বসে বসে কাঁদছে! হারু বড় আদুরে ছেলে, মারামারিতে সে পড়ে গেছে দেখেই আর সকলে মার খাবার ভয়ে সেখান থেকে চম্পট দিয়েছে। ‘হারু পড়ে গেছে’ বলে এত যে কান্না, তার অর্থ, সকলকে জানানো হচ্ছে যে ‘হারুকে আমরা ফেলে দিইনি-সে পড়ে গেছে বলে আমাদের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।’
হারু তখন সকলের নামে বাবার কাছে নালিশ করবার জন্য মনে মনে অভিমান জমিয়ে তুলছিল-হঠাৎ তার বাবাকে লোকজন আর ডাক্তার-সুদ্ধ এগিয়ে আসতে দেখে, ভয়ে তার আর নালিশ করাই হলো না। যা হোক, হারুকে আস্ত দেখে সবাই এমন খুশি হলো যে শাসনটাসনের কথা কারও মনেই এল না।
সবচেয়ে বেশি জোরে কেঁদেছিলেন হারুর ঠাকুরমা। তিনি আবার কানে শোনেন কিছু কম। তাঁকে সবাই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এত কাঁদছিলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কি অত জানি? দেখলুম ঝিয়েরা কাঁদছে, বৌমা কাঁদছেন, তাই আমিও কাঁদতে লাগলুম-ভাবলুম একটা কিছু হয়ে থাকবে।’
খানিক বাদেই শুনি একতলা থেকে কান্নাকাটির শব্দ উঠছে। বাইরের ঘরে যদুর বাবা গণেশবাবু ছিলেন-তিনি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’ শুনতে পেলেন ছেলেরা কাঁদছে, ‘হারু পড়ে গিয়েছে।’ বাবু তখন দৌড়ে গেলেন ডাক্তার ডাকতে।
পাঁচ মিনিটে ডাক্তার এসে হাজির, কিন্তু হারু কোথায়? বাবু বললেন, ‘এদিকে তো পড়েনি, ভেতর বাড়িতে পড়েছে বোধহয়।’ কিন্তু ভেতর বাড়িতে মেয়েরা বললেন, ‘এখানে তো পড়েনি-আমরা তো ভাবছি বার-বাড়িতে পড়েছে বুঝি।’ বাইরেও নেই, ভেতরেও নেই, তবে কি ছেলে উড়ে গেল? তখন ছেলেদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোথায় রে? কোথায় হারু?’ তারা বললে, ‘ছাতের উপর।’ সেখানে গিয়ে তারা দেখে, হারু বাবু অভিমান করে বসে বসে কাঁদছে! হারু বড় আদুরে ছেলে, মারামারিতে সে পড়ে গেছে দেখেই আর সকলে মার খাবার ভয়ে সেখান থেকে চম্পট দিয়েছে। ‘হারু পড়ে গেছে’ বলে এত যে কান্না, তার অর্থ, সকলকে জানানো হচ্ছে যে ‘হারুকে আমরা ফেলে দিইনি-সে পড়ে গেছে বলে আমাদের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।’
হারু তখন সকলের নামে বাবার কাছে নালিশ করবার জন্য মনে মনে অভিমান জমিয়ে তুলছিল-হঠাৎ তার বাবাকে লোকজন আর ডাক্তার-সুদ্ধ এগিয়ে আসতে দেখে, ভয়ে তার আর নালিশ করাই হলো না। যা হোক, হারুকে আস্ত দেখে সবাই এমন খুশি হলো যে শাসনটাসনের কথা কারও মনেই এল না।
সবচেয়ে বেশি জোরে কেঁদেছিলেন হারুর ঠাকুরমা। তিনি আবার কানে শোনেন কিছু কম। তাঁকে সবাই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এত কাঁদছিলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কি অত জানি? দেখলুম ঝিয়েরা কাঁদছে, বৌমা কাঁদছেন, তাই আমিও কাঁদতে লাগলুম-ভাবলুম একটা কিছু হয়ে থাকবে।’
বাজে গল্প ১
দুই বন্ধু ছিল। একজন অন্ধ আরেকজন বদ্ধ কালা। দুইজনে বেজায় ভাব। কালা বিঞ্জাপনে পড়িল আর অন্ধ লোকমুখে শুনিল, কোথায় যেন যাত্রা হইবে, সেখানে সঙেরা নাচগান করিবে। কালা বলিল, ``অন্ধ ভাই, চল, যাত্রায় গিয়া নাচ দেখি।'' অন্ধ হাত নাড়িয়া, গলা খেলাইয়া কালাকে বুঝাইয়া দিল, ``কালা ভাই, চল, যাত্রায় নাচগান শুনিয়া আসি।''
দুইজনে যাত্রার আসরে গিয়া বসিল। রাত দুপুর পর্যন্ত নাচগান চলিল, তারপর অন্ধ বলিল, ``বন্ধু, গান শুনিলে কেমন?'' কালা বলিল, ``আজকে তো নাচ দেখিলাম- গানটা বোধহয় কাল হইবে।'' অন্ধ ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া বলিল, ``মূর্খ তুমি! আজ হইল গান- নৃত্যটাই বোধহয় কাল হইবে।"
কালা চটিয়া গেল। সে বলিল ``চোখে দেখ না, তুমি নাচের মর্ম জানিবে কি?'' অন্ধ তাহার কানে আঙুল ঢুকাইয়া বলিল, ``কানে শোন না, গানের তুমি কাঁচকলা বুঝিবে কি?'' কালা চিত্কার করিয়া বলিল, ``আজকে নাচ, কালকে গান,'' অন্ধ গলা ঝাঁকড়াইয়া আর ঠ্যাং নাচাইয়া বলিল, ``আজকে গান, কালকে নাচ।''
সেই হইতে দুজনের ছাড়াছাড়ি। কালা বলে, ``অন্ধটা এমন জুয়াচোর-সে দিনকে রাত করিতে পারে।'' অন্ধ বলে, ``কালাটা যদি নিজের কথা শুনিতে পাইত, তবে বুঝিত সে কতবড় মিথ্যাবাদী।''
দুইজনে যাত্রার আসরে গিয়া বসিল। রাত দুপুর পর্যন্ত নাচগান চলিল, তারপর অন্ধ বলিল, ``বন্ধু, গান শুনিলে কেমন?'' কালা বলিল, ``আজকে তো নাচ দেখিলাম- গানটা বোধহয় কাল হইবে।'' অন্ধ ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া বলিল, ``মূর্খ তুমি! আজ হইল গান- নৃত্যটাই বোধহয় কাল হইবে।"
কালা চটিয়া গেল। সে বলিল ``চোখে দেখ না, তুমি নাচের মর্ম জানিবে কি?'' অন্ধ তাহার কানে আঙুল ঢুকাইয়া বলিল, ``কানে শোন না, গানের তুমি কাঁচকলা বুঝিবে কি?'' কালা চিত্কার করিয়া বলিল, ``আজকে নাচ, কালকে গান,'' অন্ধ গলা ঝাঁকড়াইয়া আর ঠ্যাং নাচাইয়া বলিল, ``আজকে গান, কালকে নাচ।''
সেই হইতে দুজনের ছাড়াছাড়ি। কালা বলে, ``অন্ধটা এমন জুয়াচোর-সে দিনকে রাত করিতে পারে।'' অন্ধ বলে, ``কালাটা যদি নিজের কথা শুনিতে পাইত, তবে বুঝিত সে কতবড় মিথ্যাবাদী।''
Subscribe to:
Posts (Atom)