সখের প্রাণ গড়ের মাঠ
ছাত্র দুটি করেন পাঠ-
পড়ায় নাইকো মন
(সবাই) হচ্ছে জ্বালাতন !
অতি ডেঁপো দুকান কাটা
ছাত্র দুটি বেজায় জ্যাঠা,
কাউকে নাহি মানে
(সবাই) ধর ওদের কানে !
গুরুমশাই টিকিওয়ালা
নিত্যি যাবেন ঝিঙেটোলা
জমিদারের বাড়ি
(সেথা) আড্ডা জমে ভারি !
পণ্ডিতঃ (স্বগত) রোজ ভাবি জমিদারমশাইকে বলে কয়ে তার বাড়িতেই একটা টোল বসাব। তা, একটু নিরিবিলি যে কথাটা পাড়ব, সে আর হয়ে উঠল না । বলি ন্যায়শাস্ত্র যে পড়েনি সে মানুষই নয়- সে গরু, মর্কট !
[নেপথ্যে সংগীত]
এই !- আবার চলল ! এ এখন সারাদিন চলতে থাকবে ! গলা ত নয়, যেন ফাটা বাঁশ ! গানের তাড়ায় পাড়াসুদ্ধ লোক ত্রাহি ত্রাহি কচ্ছে- কাগটা পর্যন্ত ছাতে বসতে ভরসা পায় না, অথচ ভাবখানা এমনি, যেন গান শুনিয়ে আমাদের সাতচোদ্দং তিপ্পান্ন পুরুষ উদ্ধার করে দিচ্ছে ! আ মোলো যে-
[ঘটিরামের প্রবেশ]
পণ্ডিতঃএত দেরি হল কেন ? এতক্ষণ কী কচ্ছিলি ?
ঘটিরামঃআজকে শিগগির শিগগির ছুটি দিতে হবে !
পণ্ডিতঃবটে ! অনেকদিন পিঠে কিছু পড়েনি বুঝি ! ছুটি কিসের ?
ঘটিরামঃতাও জানেন না ! ও পাড়ায় গানের মজলিস হবে যে ! বড় বড় ওস্তাদ-
পণ্ডিতঃ না, না, ছুটি পাবিনে- যা ! পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এসেই ছুটির খোঁজ-
ঘটিরামঃ বাঃ ! ঝিঙেটোলার জমিদারবাবু আসবেন !
পণ্ডিতঃ লাট সাহেব এলেও যেতে পাবিনে। কেষ্টা কোথায় ?
ঘটিরামঃ জানিনে। ডেকে আনব ? ওরে কেষ্ট।
[প্রস্থানোদ্যম]
পণ্ডিতঃ থাক্ থাক্ , ডাকতে হবে না। ওখানে বসে পড়।
ঘটিরামঃ 'অল ওয়ার্ক্ অ্যান্ড্ নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয়'- বালকদিগকে খেলিবার সুযোগ দেওয়া উচিত, কেননা, কেবল লেখাপড়া করিলে মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বালকদিগকে খেলিবার সুযোগ দেওয়া উচিত, কেননা, কেবলই লেখাপড়া করিলে মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়- স্ফুর্তি সব মাটি । কেননা, কেবলই লেখাপড়া মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়- এই আমাদের যেমন হয়েছে । কেননা-
পণ্ডিতঃ ও জায়গাটা পাঁচশোবার করে পড়তে হবেনা । তোর অন্য পড়া নেই ? -ঐ যে পুলিসটা যাচ্ছে, ওকে একটু ডাকা যাক্ । এই পাহারাওয়ালা - ইদিকে আও ।
[পুলিসের প্রবেশ]
পুলিসঃ কেয়া বোল্তা বাবু ?
পণ্ডিতঃ আহা, এইটা দেখি একেবারে নিরক্ষর মুর্খ ! আরে, পাশের বাড়িমে একঠো গানের ওস্তাদ হায় নেই ? উস্কো একদম কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেহি হায় - দিনরাত ভর কেবল সারে গামা ভাঁজতা হায় ।
পুলিসঃ কেয়া হোতা ?
পণ্ডিতঃ আরে, খেলে যা ! (সুর করিয়া) সারে গাগা মাপা ধানি ধানি এইসা করতা হায়-
পুলিসঃ হাম কেয়া করেগা বাবু- উ হামারা কাম নেহি ।
পণ্ডিতঃ নাঃ তোমার কাজ না ! মাইনে খাবে তুমি আর কাজ করবে বেচারাম তেলি !
পুলিসঃ হাঁ বাবু ।
পণ্ডিতঃ চেঁচাস কাঁহে ? ফের পূজার বকশিশ চায়গা ত এইসা উত্তম মধ্যম দেগা- থোঁতামুখ ভোঁতা কর দেগা ।
পুলিসঃ আরে, পাগলা হায়রে- পাগলা হায় ! [প্রস্থান]
পণ্ডিতঃ দেখ ! ছোঁড়াটার আর সারাশব্দ নেই ! ঘটে !
ঘটিরামঃ অ্যাঁ-
পণ্ডিতঃ 'অ্যাঁ' কি রে বেয়াদব ? 'আজ্ঞে' বলতে পারিসনে ? আধঘণ্টা ধরে 'অ্যাঁ' করতে লেগেছে ! বলি, পড়ছিস না কেন ?
ঘটিরামঃ হ্যাঁ, পড়ছিলাম ত !
পণ্ডিতঃ শুনতে পাই না কেন ? চেঁচিয়ে পড় !
ঘটিরামঃ (চিৎকার) অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড-
পণ্ডিতঃ থাক্ থাক্- অত চেঁচাসনে- একেবারে কানের পোকা নড়িয়ে দিয়েছে ।
[কেষ্টার প্রবেশ]
কেষ্টাঃ লেখাপড়া করে যেই গাড়িচাপা পড়ে সেই । শুনলুম আজকে ও পাড়ায় গানের মজলিস হবে ।
পণ্ডিতঃ এতক্ষনে পড়তে এসেছিস ?
কেষ্টাঃ ' আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন '- সেই কখন এসেছি - এতক্ষন কত পড়ে ফেললাম ! ' আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন্ '-
পণ্ডিতঃ যা, যা, আমি যেন আর দেখিনি, কাল আসিস্ নি কেন ?
কেষ্টাঃ কালকে, কাল কি করে আসব ? ঝড় বৃষ্টি বজ্রাঘাত-
পণ্ডিতঃ ঝড় বৃষ্টি কিরে ? কাল ত দিব্যি পরিষ্কার ছিল !
কেষ্টাঃ আজ্ঞে, শুক্কুরবারের আকাশ, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই কখন কি হয়ে পড়ে !
পণ্ডিতঃ বটে ! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টাঃ আজ্ঞে, ঐ তালতলায়- 'আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন্ -' মানে কি?
পণ্ডিতঃ 'আই'- 'আই' কিনা চক্ষুঃ, 'গো- গয়ে ওকারে গো গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ 'আপ্' কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল- গরুর চক্ষে জল- অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে- কেন কাঁদিতেছে- না উই গো ডাউন', কিনা 'উই' অর্থাৎ যাকে বলে উইপোকা- 'গো ডাউন', অর্থাৎ গুদোমখানা- গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না- তাই না দেখে, 'আই গো আপ্ ' গরু কেবলি কান্দিতেছে-
[ঘটির বিকট হাস্য]
পণ্ডিতঃ ঘটে !
ঘটিরামঃ অ্যাঁ- না আজ্ঞে-
পণ্ডিতঃ ফের ওরকম বিটকেল শব্দ করবি ত পিটিয়ে সিধে করে দেব ।
[নিদ্রাচেষ্টা]
কেষ্টাঃ পণ্ডিতমশাই, ও পণ্ডিতমশাই !
ঘটিরামঃ ঘুমুচ্ছে? (ঠেলিয়া) ও পণ্ডিতমশাই ! কেষ্টা ডাকছে, কেষ্টা ডাকছে-
কেষ্টাঃ পণ্ডিতমশাই, এই জায়গাটা বুঝতে পারছি না ।
পণ্ডিতঃ হু!, দেখি নিয়ে আয়, কোন জায়গাটা- সব বলে দিতে হবে ! তোদের দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না ! 'ওয়ান্স্ আই মেট্ এ লেম্ ম্যান ইন এ স্ট্রিট নিয়ার মাই হাউস্ ' । 'ওয়ান্স্ আই মেট্ এ লেম্ ম্যান্ '- কিনা একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল ।' 'ইন্ এ স্ট্রিট'- সে বিস্তর চেষ্টা করিল 'নিয়ার মাই হাউস্ '- কিন্তু হাড় বাহির হইল না । এই সোজা ইয়েটা বুঝতে পাল্লি না? (ঘটিরামের প্রতি) কিরে? পালাচ্ছিস যে !
ঘটিরামঃ নাঃ, পালাচ্ছি না ত ! কেষ্টা এমনি গোলমাল কচ্ছে- কিচ্ছু আঁক কষতে পাচ্ছি না ।
পণ্ডিতঃ কি আঁক দেখি নিয়ে আয় ।
ঘটিরামঃ আজ্ঞে এই যে ! এই চার সের আলুর দাম যদি দশ আনা হয় তবে আদ্ মোন পটলের দাম কত ?
পণ্ডিতঃ দেখি, চার সের আলু দশ আনা ত ! তবে আদ্ মোন পটল- আহা, আবার পটল এল কোত্থেকে ?
ঘটিরামঃ তা তো জানি না, বোধ হয় পটলডাঙা থেকে ?
পণ্ডিতঃ দুৎ ! একি একটা আঁক হতে পারে ? গাধা কোথাকার !
ঘটিরামঃ তাই বলুন ! আমি কত যোগ করলাম, ভাগ করলাম, শেষটায় জি-সি-এম্ পর্যন্ত করলাম, কিছুতেই হচ্ছিল না। বড্ড শক্ত- না ?
পণ্ডিতঃ মেলা বকিস নে, যাঃ !
ঘটিরামঃ যাব ? ছুটি ?
কেষ্টাঃ ছুটি- ছুটি- ছুটি-
পণ্ডিতঃ না, না, ছুটি টুটি হবে না ।
ঘটিরামঃ হ্যাঁ ভাই, তুই সাক্ষী আছিস, বলেছে যা !
কেষ্টাঃ হ্যাঁরে, আমাদের কিন্তু দোষ নেই ।[প্রস্থান]
পণ্ডিতঃ দেখলে কাণ্ডটা ! এই সব হুজুকেই ত ছেলেগুলোকে মাটি করলে ! আর জমিদারমশাইয়ের আক্কেলটা দেখ - এখানে এসে অবধি দশভূতে তাকে পেয়ে বসেছে - দেখ দেখি, টাকা ওড়াবার জন্য শেষটায় কিনা গানের মজলিস ! ছ্যা ছ্যা !
[প্রস্থান]
সাবধান হয়ে সবে অবধান কর রে ।
ওহে শিষ্য গুণধর কোলাহল ছাড় রে ।।
(আহা) কেনা জানে চণ্ডীবাবু ঝিঙেটোলার জমিদার ।
(আহা) অনুরক্ত ভক্ত মোরা চরণে প্রণমি তার ।।
(ওসে) বিক্রমে বিক্রমাদিত্য সর্বশাস্ত্রে ধুরন্ধর ।
(আহা) সাক্ষাৎ যেন দাতাকর্ণ দানব্রতে ভয়ঙ্কর ।।
(এরা) খাচ্ছে দাচ্ছে ফুর্তি কচ্ছে নিত্য তারি কল্যাণে ।
(সেথা) চব্বিশ ঘণ্টা মারছে আড্ডা বখশিশাদি সন্ধানে ।।
(সেথা) নিত্য নতুন হচ্ছে হল্লা লোকারণ্য মারাত্মক ।
(সেথা) বাদ্যের ঘটা খাদ্যের ঘটা অর্থের শ্রাদ্ধ অনর্থক ।।
(আহা) একজন বড্ড সাধাসিধে ভেদ করে না আত্মপর ।
(আর) টাকার লোভে বসে থাকে যত ব্যাটা স্বার্থপর ।।
(ওরে) পণ্ডিৎমশাই ব্যস্ত বড্ড চণ্ডীবাবুর হিতার্থ ।
(দেখ) অন্নলুচি ধ্বংস করি কচ্ছেন সবায় কৃতার্থ ।।
(আহা) বিদ্যে জাহির কচ্ছে সবাই পোলাও কোর্মা ভোজনে ।
(দেখ) যত রাজ্যের নিষ্কম্মার দল বাড়ছে সবাই ওজনে ।।
(ওরে) অবিশ্রান্ত হুজুক নিত্য মুহূর্তেকো শান্তি নেই ।
(আজ) পঞ্চ বর্ষ অন্ত হৈল ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই ।।
(ওরে) কস্মিনকালে শুনি নাই রে এমন কাণ্ডকারখানা ।
(ওই) খোসামুদে ভণ্ডগুলো আহ্লাদেতে আটখানা ।।
(আহা) পুষ্পচন্দন বৃষ্টি হবে চণ্ডীবাবুর মস্তকে ।
(দেখ) অক্ষয় পুণ্য সঞ্চয় হবে চিত্রগুপ্তের পুস্তকে ।।
like it
ReplyDeletelike it
ReplyDelete